রাজধানীজুড়ে আন্দোলন। ঢাকা এখন আন্দোলনে অচল এক নগরী। একটা আন্দোলন শেষ হতে না হতেই নতুন আন্দোলন শহরকে বন্দি করে। তিন দিনের আন্দোলনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সব দাবি মেনে নেয় সরকার। সবই হলো শুধু জনগণকে পোহাতে হলো দুর্বিষহ দুর্ভোগ। সাম্য হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখনো উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইশরাক হোসেনকে মেয়র করতে নগর ভবনের সামনে চলছে অবস্থান কর্মসূচি। কোথাও যেন কোনো সুখবর নেই। সাধারণ মানুষ হতাশ, বিরক্ত। এভাবে আর কত দিন! শান্তি কত দূরে? রাজনৈতিক নেতারা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাচ্ছেন। কোথায় যেন হচ্ছে কোন সর্বনাশ। রাজনৈতিক অঙ্গনে জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে হানাহানি বাড়ছে, বাড়ছে দূরত্ব, অবিশ্বাস, সন্দেহ।
৯ মাস ধরে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের দাবিদাওয়ার এক স্তূপে পরিণত হয়েছে যেন বাংলাদেশ। যে যার মতো করে আন্দোলন করছে, কলমবিরতি করছে, ধর্মঘট করছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানা রকম অস্বস্তির খবর পাচ্ছি। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নানা রকম আন্দোলনে জনজীবন যেন দিশাহারা। ৯ মাস ধরে বিরামহীনভাবে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। অর্থনীতি পঙ্গু হয়ে গেছে। দেশ রীতিমতো অচল। মানুষ চরম বিরক্ত।
সংকট বাড়ছে। পরিস্থিতি আস্তে আস্তে চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সবকিছু থেকে দ্রুত উত্তরণ প্রয়োজন। আর এই উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো, দ্রুত নির্বাচন। একটি অন্তর্বর্তী সরকার পর্বতসম দাবিদাওয়া মেটাতে পারবে না। এসব দাবিদাওয়া মেটাতে গিয়ে নতুন নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হবে এবং হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে দ্রুত উত্তরণের জন্য নির্বাচনই একমাত্র সমাধান। দ্রুত জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এখন সময়ের দাবি।
নির্বাচনে কীভাবে সমাধান, আসুন একটু খতিয়ে দেখা যাক। এখন যেমন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানান পেশাজীবী তাদের দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করছেন। যখনই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে, তখনই এসব দাবিদাওয়ার ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের একটি অবস্থান ব্যাখ্যা করবে। তারা নির্বাচিত হলে এসব দাবিদাওয়ার ব্যাপারে কে কী করবে, সে সম্পর্কে জনগণকে বা আন্দোলনকারীদের একটা সুস্পষ্ট ধারণা দেবে, দেবে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি। এ ধরনের আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সঙ্গেই আন্দোলন স্তিমিত হবে। আন্দোলনকারীরা বুঝতে পারবেন যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ এখন নির্বাচন। কাজেই নির্বাচিত সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে সবকিছু। তারা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। নির্বাচনের পরে যে দল জয়ী হবে, তারা আন্দোলনকারীদের দাবিদাওয়াগুলোর ব্যাপারে নির্বাচনকালীন যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমেই একমাত্র বিভিন্ন আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনা যেতে পারে। জনজীবন স্বাভাবিক করা যেতে পারে। আর নির্বাচন দেওয়ার সময় যত দীর্ঘ হবে তত বিভিন্ন নতুন নতুন ইস্যু সৃষ্টি হবে। নতুন নতুন দাবিদাওয়া নিয়ে রাজপথে আন্দোলন শুরু হবে। কারণ যখন নির্বাচন অনিশ্চিত তখন যারা বিভিন্ন দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত তারা মনে করবে, এখনই সময় দাবিদাওয়া আদায় করার। ফলে দাবির স্তূপ বাড়বে এবং সরকার তার মূল লক্ষ্য থেকে সরে যাবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বর্তমান সরকার একটি অন্তর্বর্তী সরকার। এই সরকারের সুনির্দিষ্ট তিনটি এজেন্ডা রয়েছে, এই তিনটি কাজ করার মধ্য দিয়ে তাদের একটি গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস একাধিকবার এই বিষয়টি বলেছেন।
প্রথম এজেন্ডা হলো জুলাই গণহত্যার বিচার। জুলাই গণহত্যার বিচারের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। শেখ হাসিনাসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। কাজেই এই বিচার এগোচ্ছে এবং বিচারকে তার নিজস্ব পথে চলতে দিতে হবে। বিচারে যেন কেউ বাধা সৃষ্টি করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারপ্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোকে এককাট্টা কাজটি দায়িত্বপ্রাপ্তরা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেছেন। সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন জুলাই গণহত্যার ওপর যে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে সেটি ঐতিহাসিক একটি দলিল। এই দলিলের ভিত্তিতে যে কোনো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে জুলাই গণহত্যার বিচার করা সম্ভব। কাজেই বিচারপ্রক্রিয়াকে তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এগোতে দিতে হবে। বিচারে কোনো রকম হস্তক্ষেপ বা কারও ওপর বাড়তি চাপ প্রয়োগ সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আমরা আশা করি, কেউই এ ধরনের দায়িত্বহীন কাজ করবে না। কাজেই অন্তর্বর্তী সরকার তার প্রথম দায়িত্ব সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেছে।
এই সরকারের দ্বিতীয় কাজ ছিল একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র সংস্কারের পথনির্দেশনা দেওয়া। আর এজন্যই ড. মুহাম্মদ ইউনূস সঠিকভাবেই অনেকগুলো কমিশন গঠন করেছিলেন। যেমন সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন সংস্কার কমিশন ইত্যাদি। এসব কমিশনের মধ্যে দুই-একটি কমিশন বাদে অধিকাংশ কমিশনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলো ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছে। ইতোমধ্যে সবগুলো কমিশনের সুপারিশকে একত্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করা হচ্ছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস অত্যন্ত সঠিকভাবেই একটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করেছেন। নির্বাচনের পর যেন আমাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না হয়। রাষ্ট্র সংস্কারে ন্যূনতম বিষয়ে যেন আমরা একমত হয়ে এগোতে পারি, সেজন্যই ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই ঐকমত্য কমিশন সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে সর্বসম্মতভাবে একটা সুপারিশ করা চূড়ান্ত করবে এবং এই সুপারিশমালাকে বলা হবে ‘জুলাই সনদ’। এই জুলাই সনদে সব রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করবে। এটি হবে একটি ঐতিহাসিক দলিল এবং এই দলিলই হবে আগামী দিনের রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি। সে ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করেছি যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটা ঐক্যের আবহ তৈরি হয়েছে। কিছু কিছু বিষয়ে বিরোধ থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কারের বেশির ভাগ বিষয়ে একমত। কিন্তু ঐকমত্য কমিশনের কারও কারও মধ্যে একধরনের কালক্ষেপণের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এখানে কালক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। সময় যত গড়াবে সংকট তত গভীর হবে। খুব দ্রুত ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে গণমাধ্যম সংস্কার কিংবা নারী সংস্কার, জনপ্রশাসন সংস্কারের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। এটি নির্বাচিত সরকারের কাজ। এই সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলো নিয়ে ইতোমধ্যেই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এখনই এসব নিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রয়োজন নেই। মৌলিক যে কয়েকটি রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয় যেমন সংবিধান সংশোধন, নির্বাচন কমিশন সংশোধন সুপারিশে একমত হয়েই ‘জুলাই সনদ’ তৈরি করা যেতে পারে। এটি জুলাই সনদের মূল আকাক্ষার জায়গা।
জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকারের একমাত্র কাজ হওয়া উচিত নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করা এবং দেশকে নির্বাচনের পথে নিয়ে যাওয়া। কারণ অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচনের সময়সূচি ঘোষণা নিয়ে যত কালক্ষেপণ করবে, ততই জনগণের মধ্যে নানা রকম সন্দেহ, অবিশ্বাস তৈরি হবে। জনগণ মনে করবে এই সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে চায়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও একধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। যা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
এ কথা ভুলে গেলে চলবে না। অন্তর্বর্তী সরকার সব রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব। রাজনৈতিক দলগুলো একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করার জন্যই অন্তর্বর্তী সরকারকে দায়িত্ব দিয়েছে। কাজেই এই সরকারের প্রধান শক্তি হলো রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন এবং সহযোগিতা। রাজনৈতিক দলগুলো যদি তাদের সমর্থন বা সহযোগিতা না করে তাহলে পরবর্তী সরকার ব্যর্থ হতে বাধ্য। জুলাই বিপ্লবের মূল শক্তি হলো জাতীয় ঐক্য। সব রাজনৈতিক দল তাদের নিজেদের ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ অবস্থানে গিয়েছিল। সেই ঐক্য ধরে রাখার দায়িত্ব হলো ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের। আর সে কারণেই অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উচ্চাশা বা নির্বাচন নিয়ে কালক্ষেপণ করা মোটেও ঠিক হবে না। এর ফলে একদিকে যেমন জন অনাস্থা তৈরি হবে, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করবে। ইতোমধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ করছি। যেমন মানবিক করিডরে ইস্যুতে বিএনপি, জামায়াত তাদের অবস্থান সুস্পষ্ট করেছে। তারা এই করিডর সবার সঙ্গে আলোচনা না করে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রবল বিরোধিতা করবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। কাজেই এসব বিতর্কিত বিষয় সামনে এনে জাতীয় ঐক্য যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। বর্তমান বাস্তবতায় একটি খণ্ডকালীন সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে একটি বাজে দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হয়। আর এ কারণেই অন্তর্বর্তী সরকার যদি দীর্ঘদিন থাকে তাহলে তাদের যে বিপুল সমর্থন এবং ঐক্য ছিল, তা তারা হারাতে পারে। জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হতে পারে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, দ্রুত নির্বাচন দিয়ে একটা নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আনা উচিত, ফ্যাসিবাদের পুনরুদ্ধার ঠেকানোর জন্য। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার বিচার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছে। এই নিষিদ্ধের পর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলে আমরা প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছি। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার পরও ফ্যাসিবাদ নতুনভাবে নানা রকম রকম ষড়যন্ত্র করছে। ভুলে গেলে চলবে না, গত সাড়ে ১৫ বছর দেশে তারা বিপুল পরিমাণ লুটপাট করেছে এবং বিদেশে তাদের বিপুল অর্থ আছে। এসব অর্থ দিয়ে তারা দেশকে অস্থিতিশীল তৈরি করার চেষ্টা করতে পারে।
বিভিন্ন জায়গায় নানা রকম ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বিপ্লবের অর্জনকে ধ্বংস করার জন্য নানা রকম চক্রান্তের খবর কান পাতলেই শোনা যায়। মনে রাখতে হবে, নির্বাচন যা পেছাবে তত নিত্যনতুন ষড়যন্ত্র ডালপালা মেলবে। নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হবে। একসময় সাধারণ মানুষ এই বিপ্লব সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতে শুরু করবে। বিপ্লবকে নিয়ে হতাশা প্রকাশ করবে। তখন এই বিপ্লবের অর্জন ব্যর্থ হয়ে যেতে বাধ্য। আমরা কি সেই পথে যাব? আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের মানুষ শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রকামী। তারা একটি নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে দ্রুত নির্বাচন হওয়া এখন সময়ের দাবি। এটাই স্বাভাবিক ছন্দে দেশকে ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ। লেখক : নাট্যকার ও কলাম লেখক
ইমেইল : [email protected]