বিগত দিনগুলোতে সংবাদপত্রের শিরোনাম আর টেলিভিশন ও মোবাইল ফোনে পাওয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পর্দা রঙিন করে তুলেছিল গোলাপি বাস, সবুজ সিএনজি ও নীল রঙের ফায়ার প্রুফ জ্যাকেট পরা এক পুলিশ সদস্যের ভিডিও চিত্র। বাংলাদেশের উন্নতি বা প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে এগিয়ে চলার ঠিক বিপরীত ও মলিন চিত্র দেখা যায়, রাজধানীর পরিবহন ক্ষেত্রে। সম্ভবত ঢাকাই বিশ্বের বুকে একটি বিরল রাজধানী, যেখানে ট্রাফিক সিগন্যালবাতির বদলে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের লাঠি বা হাতের ইশারায় রাস্তায় গাড়ির বহর থামে বা চলে। আর ২০-৩০ বছর পুরোনো যাত্রীবাহী বাস কিংবা আরও পুরোনো আমলের ইট, বালু ও ময়লা পরিবহনের ট্রাকসমৃদ্ধ একমাত্র রাজধানীও সম্ভবত ঢাকা। উঠে যাওয়া রং, ক্ষতিগ্রস্ত দরজাজানালা, লাইট এবং ভিতরে নোংরা ও ঘন করে বসানো আসন জাতি হিসেবে আমাদের দৈন্যের বহিঃপ্রকাশ। বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশ হওয়ার স্বপ্ন কিংবা উন্নত বিশ্বের কাতারে যোগদানের হাতছানিকে অলীক স্বপ্ন প্রমাণ করে আমাদের এক একটি রংচটা বাস।
ঢাকায় ঠিক কয়টি রুটে কতসংখ্যক বাস কী নামে চলে আর এসব বাসের মালিকানা কার নামে- এমন তথ্য খুঁজে পাওয়া কঠিন। আরও কঠিন এই বাস যাঁরা চালান, তাঁদের লাইসেন্স আছে কি না, কিংবা বাসগুলোর ফিটনেস ও রোড ট্যাক্স দেওয়া আছে কি না, এ-সংক্রান্ত তথ্য উদ্ধার করা। একই রুটে কোনো কোনো বাস কোনো ডিপো বা টার্মিনালের তোয়াক্কা না করে মাঝপথ থেকে চলাচল শুরু করে। বাসের গায়ে কোনো কোম্পানির নাম লেখা থাকা বা না থাকার মধ্যেও কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ বাসগুলো একটি রিকশা বা সিএনজির মতো দৈনিক জমার ভিত্তিতে চলে। ফলে বাসমালিকের নির্দিষ্ট জমার টাকা সংগ্রহ ও নিজেদের আয়-উপার্জনের জন্য বাসচালক ও তাঁদের সহকারীরা ইচ্ছেমতো রাজধানীতে বাস চালান। কোনো সময় না মানা, যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা, বাস বাঁকা করে মাঝ রাস্তা ব্লক করে একই কোম্পানির বা একই রুটের অন্যান্য বাসকে সামনে গিয়ে কোনো যাত্রী উঠতে বাধা দেওয়া রাজধানীর নিত্যদিনের চিত্র। এতে তীব্র যানজট, কর্মঘণ্টা নষ্ট, শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাঘাত, ব্যবসায়িক ক্ষয়ক্ষতি, অযথা জ্বালানি ব্যয়, এমনকি পারিবারিক ও সামাজিক ভুলবোঝাবুঝির মতো নানাবিধ সমস্যায় নাকাল রাজধানীর সাধারণ মানুষ। যানজটে আটকা পড়া অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন শুনেও রাস্তায় বাঁকা করে রাখা বাসগুলো নড়ে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যু কিংবা সন্তান প্রসবের ঘটনাও ঘটে যানজটে আটকা পড়া অ্যাম্বুলেন্সের ভিতর। এমন ঘটনায় মনে হয় ঢাকা মানুষ নয়, রোবটের রাজধানী, যাদের চিন্তাচেতনা, আবেগ-অনুভূতি সবই যেন যান্ত্রিক।
ঢাকাবাসীর কাছে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন মেয়র আনিসুল হক। নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে তিনি পরিবহন জগতের মাফিয়াদের মুখোমুখি হন। অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড ও ফুটপাতের অবৈধ দখল থেকে রাজধানীবাসীকে মুক্তি দিতে অনেকটাই সফল হয়েছিলেন। তবে তাঁর অনুপস্থিতিতে আবারও অবৈধ দখল কায়েম হয় এই রাজধানীতে, কিন্তু কোনো প্রতিকার করার সাহস কেউ দেখায়নি। দুর্নীতিই এই সাহস হারানোর নেপথ্যের কারণ বলে অনেকের ধারণা।
মেয়র আনিসুল হক যুক্ত হয়েছিলেন, ‘ঢাকা ট্রান্সপোর্ট কর্ডিনেশন অথরিটি’ (ডিটিসিএ) নামক একটি সরকার গঠিত কমিটির সঙ্গে। তাঁর নেতৃত্বে এই কমিটি নির্দিষ্ট কিছু রুটে একই কোম্পানির অধীনে বাসগুলোকে পরিচালনার পথে অনেক দূর এগিয়ে যান। তাঁর সঙ্গে করা মালিক ও শ্রমিকদের ওয়াদা ঠিক থাকলে বাসগুলো সময় ধরে ডিপো থেকে ছেড়ে যেত, যাত্রীরা নির্দিষ্ট স্থানে টিকিট কেটে লাইন ধরে বাসে ওঠানামা করতেন এবং টিকিট বিক্রির সব টাকা কোম্পানির ফান্ডে জমা হয়ে মালিক, চালক ও সহকারীদের অ্যাকাউন্টে চলে যেত। কোম্পানির মাধ্যমে গাড়িগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার এবং সব ধরনের যান্ত্রিক পরিদর্শন শেষে লাইসেন্সধারী প্রকৃত চালকদের দিয়ে চালানোর কথা ছিল। এতে বাসগুলোকে আর যাত্রী ধরার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামতে হতো না। ফলে শৃঙ্খলা ফিরে আসত রাজধানীর পরিবহনজগতে। রুটভিত্তিক এমন বাস চলাচল বিশ্বের বহু দেশের পরিবহনব্যবস্থায় একটি সফল উদাহরণ। ডিপিসিএর সদস্যরা বহু দেশের উদাহরণ প্রত্যক্ষ ও পর্যালোচনা করে চার বছর সময় নিয়ে রুটভিত্তিক বাস চলাচলই ঢাকার পরিবহন ক্ষেত্রে মোক্ষম সমাধান বলে মত দেন। বহু সভা ও সেমিনারে এ নিয়ে মোটামুটি সবাই একমত হন। কিন্তু মেয়র আনিসের অকালমৃত্যুর পর মুখথুবড়ে পড়ে নির্দিষ্ট কোম্পানির অধীনে রুটভিত্তিক বাস চলার যাবতীয় উদ্যোগ।
কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, দুর্নীতিই রুটভিত্তিক এই বাস চলাচল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। নিজ নামে বা আত্মীয়ের নামে থাকা এবং ঢাকায় চলাচলকারী বাসমালিকদের একটা বড় অংশ বিভিন্ন সরকারি বাহিনী ও সংস্থার সদস্য। তাঁরা কীভাবে বাস কিনলেন বা বাস কেনার মতো টাকা তিনি বা তাঁর নিকটাত্মীয় কীভাবে পেলেন, এমন প্রশ্নের উত্তর নেই। আয়কর সনদ নেই বাসমালিকদের আরেক অংশের, যা রুটভিত্তিতে চলা বাসের জন্য অপরিহার্য। আয়কর নথিতে উল্লেখ করার মতো আয়ের উৎস নেই অনেক বাসমালিকের। তাই মুখে যা-ই বলুক, বাস্তবে তারা রুটভিত্তিক বাস চলাচলের বিপক্ষে। তদুপরি যোগ হয়েছিল পরিবহনজগতের তথাকথিত মালিক ও শ্রমিকসংগঠনের নেতারূপী রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ এবং প্রশাসনের কিছু বিপথগামী কর্মকর্তা-কর্মচারীর নির্বিচারে চাঁদা আদায়ের মতো এক অভিশাপ।
আবার পুরোনো বাসের মালিকরা ভালো করেই জানেন, রুটভিত্তিক বাস চলাচল শুরু হলে তাঁদের ফিটনেস ও যথাযথ ডকুমেন্টবিহীন প্রায় অচল বাস কোনো কোম্পানি গ্রহণ করবে না। ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন কোনো চালক রুটভিত্তিক কোম্পানির বাস চালানোর সুযোগ পাবেন না। সুতরাং তাঁরাও এই ব্যবস্থা চান না। এমন প্রতিকূলতার মাঝেও একধরনের চাপে পড়েই সব পক্ষ মিলে সিদ্ধান্ত নেয়, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ তারিখের মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে রুটভিত্তিক বাসসেবা চালু হবে এবং মে মাসের মধ্যে অতি পুরোনো বাস ঢাকা থেকে সরিয়ে ফেলা হবে। এরই মধ্যে দেশের ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলো। অন্তর্র্বর্তী সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করাল প্যাডেলচালিত রিকশাশ্রমিক, ব্যাটারিচালিত অটোমালিক ও শ্রমিক এবং সিএনজিচালিত রিকশাচালকরা। এঁদের পরিচয় খুঁজতে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ঘুরেফিরে তাঁরা একই মানুষ, যাঁরা বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ও দুর্নীতির অর্থে বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের মালিক হয়েছেন এবং চাঁদা আদায়ের মধ্য দিয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়েছেন।
এরই মাঝে হঠাৎ ঢাকায় একটি রুটে গোলাপি রঙের বাস রুটভিত্তিক কোম্পানির আদলে দ্রুতগতিতে রাস্তায় নামানো হলো। পরে জানা গেল, অতি পুরোনো ও প্রায় অচল বাসের মালিকরা এই উদ্যোগের মূল হোতা, যাঁরা সরকারের গঠিত ডিটিসিএর ব্যবস্থাপনায় রুটভিত্তিক বাস চলাচলের সঙ্গে সংযুক্ত হতে আগ্রহী নন। উল্লেখ্য একই রুটে রুটভিত্তিক বাস এবং যত্রতত্র থামা অন্য কোম্পানির বাস পাশাপাশি চালিয়ে অতীতে প্রতিটি পাইলট প্রজেক্ট বা পরীক্ষামূলক চলাচল ব্যর্থ হয়েছে। অথচ সেই একই আদলে গোলাপি বাস নামানো হলো বিশেষ বিশেষ রুটে, যেখানে অন্যান্য বাস সেই আগের পদ্ধতিতেই চলছে। ফলে গোলাপি বাসগুলোও ঘুরেফিরে আগের মতোই রাস্তাঘাটে যাত্রী ওঠানামা করানো ও তাদের কাছ থেকে টিকিটের টাকা সংগ্রহ অব্যাহত রাখল। রুটভিত্তিক বাস চলাচল কোনো বাস্তব সমাধান নয়- এমনটা প্রমাণ করাই যেন তাদের লক্ষ্য।
যাত্রী কল্যাণ সমিতি বিভিন্ন গোলাপি বাস ও বাস কাউন্টার পরিদর্শন শেষে দাবি করেছে, বাইরের ‘লিপস্টিক’ অর্থাৎ গোলাপি রং ছাড়া আর কিছুই বদলায়নি এসব বাসে। আগের মতোই ভাঙাচোরা, নোংরা ও ঘন করে অবৈধভাবে বসানো সিট, বাসের সামনে ও পেছনে ইন্ডিকেটর লাইট, পার্কিং লাইট, ব্রেক লাইট, আয়না প্রভৃতির অভাব আর লাইসেন্সবিহীন চালক দেখা গেছে এসব বাসে। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে রুটভিত্তিক বাস চলাচলের উদ্যোগ বন্ধ করতে এমন গোলাপি স্ট্রেস বলে ধারণা করছেন সচেতন মহল।
রাজধানীকে বাঁচাতে পরিবহন সেক্টরের উন্নতির কোনো বিকল্প নেই। অথচ যত্রতত্র আগুন লাগানোর মতো দাবিদাওয়া আদায়ের নামে সমস্যা তৈরি করে সরকারকে যেন অগ্নিনির্বাপণে ব্যস্ত রেখেছে আগে সুবিধাভোগী ও চক্রান্তকারীরা যৌথ কাজ করছে- এর মতো যৌথ ট্রান্সপোর্ট ফোর্স তৈরি করে পরিবহন সমস্যা থেকে উত্তরণ এখন সময়ের দাবি।
২০১৮ সালে ঢাকায় চলাচলকারী সিএনজি মিটারে না চললে ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হয়। ২০২৫ সালে এসে ঠিক এই সময়ে একই বিধান প্রজ্ঞাপন আকারে কেন বের করা হলো- তার উত্তর মেলেনি। অথচ মিলেছে আরেক দফা ভোগান্তি। সিএনজি শ্রমিক ও মালিকরা এ নিয়ে রাজধানীর রাস্তা অবরোধ করে দিলে অচল হয়ে পড়ে ঢাকা। সিএনজি গ্যাসের দাম বেড়েছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। অথচ বহু আগে নির্ধারণ করা কিলোমিটার প্রতি বিল বাড়েনি বা যাত্রী ভাড়া সমন্বয় করা হয়নি। এমতাবস্থায় মিটারে না চললে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করার প্রজ্ঞাপন জারি হলে হিতে বিপরীত হবে কিংবা এ নিয়ে বাদানুবাদ, বিতর্ক, এমনকি প্রতিবাদও অবধারিত ছিল। তবে এমনটা অনুমান করার ক্ষমতা এক শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর হয় লোপ পেয়েছিল, অথবা তারা ইচ্ছা করেই সরকারকে বিপাকে ফেলতে এবং জনজীবনে অস্বস্তি তৈরি করতে এমন পরিস্থিতির দিকে সব পক্ষকে ঠেলে দিয়েছিল, যা কখনো কারও কাম্য ছিল না। তাদের জারি করা প্রজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে সরকারের বিরুদ্ধে সিএনজিমালিক ও চালকদের একধরনের ক্যু আকারে অবরোধ হলো এবং প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার তথা ক্যু সফল হলো। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতেই বিগত আমলের সরকার সমর্থকরা এমনটা করেছেন কি না, তা তদন্তের দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে।
গোলাপি বাস ও সবুজ রঙের সিএনজি নিয়ে এমন হতাশার মাঝেও আশার আলো জ্বেলেছেন নীল রঙের ফায়ার টু জ্যাকেট পরা এক পুলিশ সদস্য। সচিবালয়ের সামনে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে এই পুলিশ সদস্য তাঁর হাতে থাকা শক্ত লাঠি দিয়ে বারবার রাস্তায় ও রাস্তার পাশে থাকা বিদ্যুতের খুঁটিতে আঘাত করে শব্দ করে ও ভয় দেখান। একই সময়ে ফায়ার প্রুফ নীল জ্যাকেট পরা অন্য পুলিশ সদস্যরাও বাঁশিতে তীব্র আওয়াজ তুলে ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে এবং আন্দোলনকারীদের গায়ে আঘাত না করেই তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। এমন উদাহরণ জনগণকে আশার আলো দেখায়।
গোলাপি নিয়ে ভাঁওতাবাজি আর সবুজ নিয়ে ষড়যন্ত্রের সাগরে সাগরের নীল জলরাশিতে ধুয়েমুছে যাক আর নীল আকাশে উঠুক শান্তির সাদা পতাকা- এটাই প্রত্যাশা।
♦ লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
Email: [email protected]