একটা সময় ছিল, সন্ধ্যা নামলেই পরিবারের সবাই মিলে টেলিভিশনের সামনে বসতাম। বাবা চায়ের কাপ হাতে, মা রান্নাঘরের কাজ শেষ করে এসে পাশে বসছেন, ভাইবোনেরা পাটি বিছিয়ে, পর্দায় তখন এই সব দিন রাত্রি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, ঢাকায় থাকি বা বহুব্রীহি। সেই সময় নাটক মানেই ছিল পরিবার, সম্পর্ক, টানাপোড়েন আর ভালোবাসার গল্প। আজ সেই দৃশ্য কল্পনাতেও আনা কঠিন। টিভি নাটকের পর্দা এখন ভরে আছে শুধুই নায়ক-নায়িকার রোমান্টিক গল্পে। বাবা-মা, ভাইবোন, প্রতিবেশী, আত্মীয়, এ চরিত্রগুলো হারিয়ে গেছে যেন। একটা সময় ছিল যখন পারিবারিক নাটক মানেই সমাজের প্রতিচ্ছবি; এখনকার নাটক যেন নিছক বিনোদনের পণ্য। লিখেছেন- পান্থ আফজাল
বিটিভির সোনালি যুগ : যখন নাটক মানেই পরিবার
বিটিভির যুগে পরিবারই ছিল টেলিভিশন নাটকের কেন্দ্রবিন্দু। তখনকার নাটকগুলো আমাদের জীবনের গল্প বলত, যেমন হাসি-কান্না, ভালোবাসা, ভুল বোঝাবুঝি, কিংবা জীবনের ছোট ছোট সাফল্য। ‘এই সব দিন রাত্রি’-তে আমরা দেখেছি শহরের চাকরিজীবী এক পরিবারের সংগ্রাম, ‘অয়োময়’ দেখিয়েছে প্রজন্মের সংঘাত, ‘ঢাকায় থাকি’ দেখিয়েছে নগরজীবনের বাস্তবতা, আর ‘কোথাও কেউ নেই’ বা ‘বহুব্রীহি’ প্রমাণ করেছে নাটক কেবল কল্পনা নয়, মানুষের আবেগকে নাড়িয়ে দিতে পারে। স্মরণ কর ‘কোথাও কেউ নেই’-এর বাকের ভাইকে। নাটকের শেষে তার ফাঁসির রায় ঘোষণার পর দর্শক রাস্তায় নেমেছিল প্রতিবাদে। স্লোগান উঠেছিল- ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে।’ সেই সময়ে কুত্তাওয়ালী চরিত্রে অভিনয় করা শিল্পীর নিরাপত্তার জন্য পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। এমন উন্মাদনা কোনো সিনেমাতেও দেখা যায়নি। অন্যদিকে ‘ঢাকায় থাকি’ ধারাবাহিকে টুনী নামের এক শিশুর ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কাহিনি গোটা জাতিকে কাঁদিয়েছিল। দর্শক টুনীর আরোগ্যের জন্য বাস্তবে দোয়া করেছিলেন। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আফরোজা বানুর অভিনয় এত বাস্তব ছিল যে, মানুষ তাঁদের বাস্তব জীবনের দম্পতি ভেবে ফেলেছিল। এই পারিবারিক আবেগই তখনকার নাটকের প্রাণ ছিল।
এখনকার নাটক : আমি, তুমি আর সে
আজকের টিভি নাটকের চিত্র একেবারেই আলাদা। এখন গল্পে থাকে দুই-তিনটি চরিত্র-নায়ক, নায়িকা আর এক-দুজন পার্শ্বচরিত্র, যারা মূলত কৌতুকের দায়িত্বে। তারা বিকৃত অঙ্গভঙ্গি করে, হাস্যকর সংলাপ বলে, দর্শককে হাসানোর চেষ্টা করে, যেন ‘হাসানোই’ এখন প্রধান উদ্দেশ্য। একজন অভিজ্ঞ নাট্যকারের ভাষায়, ‘নির্মাতারা এখন বেশি চরিত্রের নাটক বানাতে চান না। চরিত্র যত বাড়ে, বাজেট তত ফুলে ওঠে। আবার শুটিং ব্যবস্থাপনাতেও ঝামেলা বাড়ে। তাই এখন নাটকের গল্প ঘোরে ‘আমি, তুমি, সে’-এর ভিতরেই। একজন প্রযোজক যোগ করলেন, ‘সব জিনিসের দাম বেড়েছে-শিল্পীর পারিশ্রমিক, লোকেশন ভাড়া, যাতায়াত খরচ। কিন্তু নাটকের বাজেট সেই আগের জায়গাতেই। ফলে চাইলে বাবা-মা, ভাই-বোন, চাচা-খালাকে গল্পে আনতে পারি না। বাজেটই দেয় না।’ ফলে পারিবারিক সম্পর্কের জায়গায় এসেছে প্রেমের ত্রিভুজ, প্রতারণা, থ্রিলার কিংবা চটকদার সংলাপ। পারিবারিক উষ্ণতার জায়গায় এসেছে ইউটিউব ভিউ আর ক্লিকবেইট শিরোনাম।
বাজেট নাকি অজুহাত?
এখানেই মূল প্রশ্ন-সত্যিই কি বাজেটই একমাত্র সমস্যা, নাকি আমরা অজুহাতের আড়ালে নিজেদের দায় এড়াচ্ছি? হ্যাঁ, সত্যি বাজেট কম। কিন্তু অনুভূতির বাজেট তো খরচে বাড়ে না। সম্পর্কের গল্প বলতে হলে বড় লোকেশন লাগে না; লাগে ভালো লেখা, মনের গভীরতা আর নির্মাতার ইচ্ছা। ‘বড় ছেলে’ নাটকটি তার প্রমাণ-একেবারে সীমিত লোকেশনে, ছোট বাজেটে নির্মিত সেই নাটক দর্শকের হৃদয়ে ঝড় তুলেছিল। একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্পই হয়ে উঠেছিল অসাধারণ।
হাসির নাটক, না কি কৃত্রিম কৌতুক?
আজকাল প্রচুর নাটক প্রচার হয় ‘হাসির নাটক’ নামে। কিন্তু সেই হাসি কি সত্যিকারের? অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, চরিত্রগুলো অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গি করছে, অশালীন সংলাপ বলছে, কৃত্রিম ভঙ্গিতে ‘হাসানোর’ চেষ্টা করছে। দর্শক হাসছে হয়তো, কিন্তু কোথাও একটা বীতশ্রদ্ধতাও তৈরি হচ্ছে। এক সময় বলা হতো, নাটক দেখার বিষয়, এখন অনেকেই মজা করে বলেন, নাটক খাওয়ার বিষয় হয়ে গেছে। অর্থাৎ, তাৎক্ষণিক ভোগের জন্য বানানো কনটেন্ট, যা দর্শকের মনে থেকে যায় না।
দর্শক কিন্তু এখনো চায় পারিবারিক গল্প
অদ্ভুত হলেও সত্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পুরনো বিটিভি নাটকের ক্লিপগুলো আজও ভাইরাল হয়। ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘ঢাকায় থাকি’, ‘অয়োময়’, ‘বহুবীহি’, ‘বন্ধন’, ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘আজ রবিবার’, ‘নক্ষত্রের রাত’-সব দৃশ্যের নিচে দর্শক মন্তব্য করে, ‘এমন নাটক এখন আর হয় না।’ এর মানে, দর্শক এখনো পারিবারিক কাহিনি ভালোবাসে। মানুষ এখনো সম্পর্কের গল্পে ডুবে যেতে চায়, হাসতে-কাঁদতে চায়। কিন্তু নির্মাতারা হয়তো ভুলে গেছেন, ভিউয়ের চেয়ে দর্শকের ভালোবাসা অনেক বড়।
নতুন প্রজন্মের নির্মাতারা ও চ্যালেঞ্জ
বর্তমান প্রজন্মের নির্মাতারা প্রযুক্তিতে দক্ষ, গল্পে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে জানেন। কিন্তু তাদের অনেকেই মনে করেন পারিবারিক গল্প ‘পুরনো ফরম্যাট।’ অথচ পরিবার নামের সেই চিরন্তন বিষয়টি কখনো পুরনো হয় না। ‘একান্নবর্তী’ নাটক, ‘বড় ছেলে’- দেখিয়েছে এখনো মানুষ পারিবারিক গল্পে আবেগ খুঁজে পায়। যদি আন্তরিকতা থাকে, পরিবারকেন্দ্রিক গল্প আজও দর্শক টানে।
ভাষা ও সংলাপের অবক্ষয়
বর্তমান নাটকের আরেক সমস্যা ভাষা। সংলাপে অনেক সময় এমন শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে, যা প্রকাশ বা প্রচার- কোনোটারই উপযোগী নয়। অনেক নাট্যকার মনে করেন, ‘সংলাপে গালাগালি থাকলে সেটাই নাকি বাস্তব।’ অথচ এই বাস্তবতার নামে চলছে এক ধরনের অসংযম। যে নাটক এক সময় পরিবার মিলে বসে দেখা যেত, এখন অনেক ক্ষেত্রেই তা দেখা যায় না বাবা-মায়ের সামনে। এই পরিবর্তনই সবচেয়ে ভয়ংকর।
ফিরে দেখা, ফিরে পাওয়া
বিটিভি যুগের নাটকগুলো আজও সময়ের সীমা পেরিয়ে জনপ্রিয়। এর মানে, গল্পগুলো সময়কে ছাড়িয়ে গেছে। সেসব নাটকে দেখা যেত সমাজ, নীতি, মানবিকতা, সম্পর্কের উষ্ণতা-যা এখন খুব কমই দেখা যায়। আমরা যদি সত্যিই দর্শকের হৃদয়ে জায়গা করতে চাই, তাহলে হয়তো আমাদের ফিরতে হবে সেই পরিবারকেন্দ্রিক গল্পে। বাজেট বাড়ানো না গেলে, ভালো গল্প অন্তত ফিরিয়ে আনা যায়। নাটক ও সিনেমা শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়- সমাজের প্রতিচ্ছবি। পরিবারকেন্দ্রিক গল্প হারিয়ে গেলে, সমাজও একা হয়ে যায়। আমরা সম্পর্কের উষ্ণতা হারাই, আবেগ হারাই। বাজেটের অজুহাতে যদি আমরা সেই গল্পগুলো বন্ধ করে দিই, তবে হারাবো আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড়। সময় এসেছে আবার পরিবারকে গল্পের কেন্দ্রে ফেরানোর। দর্শক প্রস্তুত; দরকার কেবল একজন নির্মাতার সাহসী সিদ্ধান্ত। হয়তো সেই দিন খুব দূরে নয়, যেদিন আবার টেলিভিশনের পর্দায় ফিরবে পরিবার, ফিরে আসবে পারস্পরিক ভালোবাসা, আর আমরা আবারও একসঙ্গে বসে বলব, ‘আজকের নাটকটা সত্যিই আমাদের গল্পের মতো লাগল।’