টানা দেড় দশকের বেশি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তাঁর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকেও দেওয়া হয়েছে একই সাজা। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে ১ হাজার ৪০০ মানুষকে হত্যা ও ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে আহত করার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে ট্রাইব্যুনাল-১ গতকাল এ রায় দেন। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। রায়ে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সব সম্পত্তি রাষ্ট্রীয় অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে গণ অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে বিতরণের আদেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। দেশের ইতিহাসে কোনো সাবেক সরকারপ্রধানের মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম। শেখ হাসিনাই প্রথম সরকারপ্রধান যিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দণ্ডিত হলেন।
এ মামলায় সমান অভিযোগ থাকলেও নিজের দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী (অ্যাপ্রুভার) হওয়ায় পাঁচ বছরের সাজা পেয়েছেন হাসিনা সরকারের শেষ পুলিশপ্রধান (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এ বিষয়ে রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘অপরাধের গভীরতা বিবেচনায় এই আসামিও (চৌধুরী মামুন) সর্বোচ্চ সাজা পাওয়ার যোগ্য। তবে অ্যাপ্রুভার হয়ে সম্পূর্ণ সত্য প্রকাশ করায় আমরা তার সাজা কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
কড়া নিরাপত্তার মধ্যে সকাল ৯টা ৫ মিনিটে কারা কর্তৃপক্ষের প্রিজন ভ্যানে সুপ্রিম কোর্ট এলাকার পুরাতন হাই কোর্ট ভবনে স্থাপিত ট্রাইব্যুনালে আনা হয় এ মামলার একমাত্র গ্রেপ্তার আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে। রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনালে আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত চৌধুরী মামুন চুপচাপ চেয়ারে বসে ছিলেন। মাথা নিচু করে পুরো রায় শুনতে দেখা যায় তাঁকে। মাঝে মাঝে হাতে থাকা ডিজিটাল তসবি চাপতেও দেখা গেছে এই রাজসাক্ষীকে। মামলার অন্য দুই আসামি ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল শুরু থেকেই পলাতক। বর্তমানে তাঁরা ভারতে আছেন বলেই জানা গেছে গণমাধ্যমের খবর থেকে। পলাতক থাকায় তাঁরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ পাবেন না বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
এ রায় ঘোষণার কার্যক্রম ট্রাইব্যুনাল থেকে সরাসরি সম্প্রচার করে বাংলাদেশ টেলিভশন, আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও দেশিবিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যম। পাশাপাশি চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয়ের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকেও সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
রায় ঘোষণা কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় কড়া নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলা হয়। নিয়মিত দায়িত্ব পালনকারী পুলিশের পাশাপাশি অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। পাশাপাশি নিরাপত্তা দিতে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও র্যাবের সদস্যরাও দায়িত্ব পালন করেন।
রায় ঘোষণার সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুহাম্মদ আবদুল জব্বার ভূঞা, মোহাম্মদ আরশাদুর রউফ, মোহাম্মদ অনীক আর হক, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, আবদুস সোবহান তরফদার, বি এম সুলতান মাহমুদ, ফারুক আহমদ, তারেক আবদুল্লাহ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান উপস্থিত ছিলেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর ও বিশেষ তদন্ত কর্মকর্তা তানভীর জোহাও উপস্থিত ছিলেন ট্রাইব্যুনালে। আসামিপক্ষে উপস্থিত ছিলেন পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন এবং গ্রেপ্তার চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের আইনজীবী জায়েদ বিন আমজাদ।
আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সদস্য ও আহতদের মধ্যে শহীদ মীর মুগ্ধর বাবা মীর মোস্তাফিজুর রহমান, ভাই মীর স্নিগ্ধ, মোহাম্মদপুরে পুলিশের গুলিতে শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকতের বোন সাবরিনা আফরোজ সেবন্তী, যাত্রাবাড়ীতে শহীদ মিরাজের বাবা আবদুর রব ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত থেকে রায় শোনেন। রায় শুনতে ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন রাকিব হাওলাদার, নিয়ামুলসহ অন্তত ১০ জন আহত জুলাই যোদ্ধা। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন ডাকসু ভিপি সাদিক কায়েম ও জিএস ফরহাদ হোসেন, ছাত্রদল নেতা আবিদুল ইসলাম, এনসিপি নেতা আরিফুর রহমান তুহিন প্রমুখ।
রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ রায়কে ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি রায় হিসেবে উল্লেখ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এ রায়ের মাধ্যমে সবাই ন্যায়বিচার পেয়েছে।’ চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘এটি ন্যায়বিচারের জন্য যাত্রা। এ রায় প্রমাণ করেছে অপরাধী যত বড় হোক, যত ক্ষমতাশালী হোক সে আইনের ঊর্ধ্বে নয়।’ অন্যদিকে এ রায়ে কষ্ট পাওয়ার কথা জানিয়েছেন পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন।
দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কানায় কানায় পূর্ণ এজলাসে ওঠেন ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারক। শুরুতেই মানবতাবিরোধী অপরাধের এ মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী, তদন্ত সংস্থার সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ধন্যবাদ জানান ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান। পাশাপাশি গণমাধ্যমকর্মী ও ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ধন্যবাদ দেন তিনি। এরপর ১২টা ৪০ মিনিটে ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ের প্রথম অংশ পড়া শুরু করেন ট্রাইব্যুনালের সদস্য বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। তাঁর পড়া শেষে বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ দ্বিতীয় অংশ পড়া শুরু করেন। রায়ের তৃতীয় ও শেষ অংশ পড়েন ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার। ২ ঘণ্টা ১০ মিনিটের সংক্ষিপ্ত রায় পড়া শেষে বেলা ২টা ৫০ মিনিটে প্রথমেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেন ট্রাইব্যুনাল। আলাদা অভিযোগে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে আমৃত্যু কারাদণ্ডের পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও পান মৃত্যুদণ্ডের সাজা। তবে রাজসাক্ষী হয়ে সত্য উদ্ঘাটন তথা বিচারকাজে সহায়তা করায় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল-১।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল যা বললেন : মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণ, যুক্তিতর্কের ব্যাখ্যা তুলে ধরে রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, গত বছর ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত চলা গণ আন্দোলনে অভিযুক্ত তিন আসামির যৌথ প্ররোচনা, উসকানি ও নির্দেশনায় সারা দেশে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। তাদের নির্দেশেই আন্দোলনকারীদের ওপর ড্রোন, হেলিকপ্টার ও মারণাস্ত্র ব্যবহার করে পুলিশ-র্যাবসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা।
গত বছর ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যা এবং সাভারের আশুলিয়ায় ছয়জনকে হত্যার পর তাদের লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার নৃশংস-নির্মম ঘটনা প্রমাণ করে যে এই আসামিদের নির্দেশে সারা দেশে ব্যাপক পরিসরে পদ্ধতিগতভাবে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে, যা রোম সংবিধি অনুসারে স্পষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধ। শুধু তাই নয়, এই তিন আসামি ঊর্ধ্বতন অবস্থানে থেকে জুলাই গণ আন্দোলনে সংঘটিত অপরাধ দমনে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। অপরাধ সংঘটনকারীদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেননি। নির্দেশদাতা কর্তৃপক্ষ হিসেবে এই নিষ্ক্রিয়তা ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার ব্যর্থতাও মানবতাবিরোধী অপরাধ।
কোটা সংস্কারের দাবিতে নামা আন্দোলনকারীদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে গত বছর ১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া শেখ হাসিনার বক্তব্য তুলে ধরে ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার এই বক্তব্য আন্দোলনকারীদের অপমান করেছে, তাদের ক্ষুব্ধ করেছে। যে কারণে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হল থেকে রাস্তায় নেমে আসে এবং বক্তব্যের জন্য তাকে (শেখ হাসিনা) প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলে।
‘আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট’, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্য আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করেছে। ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যের পর ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করেই ক্ষান্ত থাকেনি, তারা হামলায় আহতদের চিকিৎসা নেওয়ার ক্ষেত্রেও বাধা দিয়েছে।
গত বছর ১৪ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মাকসুদ কামালের সঙ্গে, ১৮ জুলাই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও শেখ হাসিনার ভাতিজা শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে এবং জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে শেখ হাসিনার ফোনালাপ নিয়েও রায়ে পর্যবেক্ষণ দেন ট্রাইব্যুনাল। প্রসিকিউশন এসব ফোনালাপ সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করে ট্রাইব্যুনালে।
ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, রাষ্ট্রনিয়োজিত আসামি পক্ষের আইনজীবী শুনানিতে দাবি করেছিলেন, এসব ফোনালাপ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি করা। রাষ্ট্রনিয়োজিত আইনজীবী এ দাবি করলেও এ দাবির পক্ষে তিনি ট্রাইব্যুনালে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। উল্টো প্রসিকিউশন দাবি করেছে, এসব ফোনালাপ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ল্যাবে ফরেনসিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং তা শেখ হাসিনা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে সত্যিকারের ফোনালাপ। ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, এসব ফোনালাপে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ ট্যাগ দিয়ে তাদের হত্যার নির্দেশ দিতে শোনা গেছে শেখ হাসিনাকে। একটি ফোনালাপে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনাও আছে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্যের অংশবিশেষ তুলে ধরে ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, জুলাই গণ অভ্যুত্থান চলাকালে দেশের ৪১টি জেলার ৪৩৮টি স্পটে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় সশস্ত্র নেতা-কর্মীরা। এ ছাড়া ৫১টি জেলায় নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের ওপর মারণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার জন্য যত রকমের ব্যবস্থা আছে সবই গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এরই ফলে ২০২৪ সালের আন্দোলনে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশগ্রহণ করে। যাদের সবাই ছিল সাধারণ-নিরীহ ও নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আন্দোলনকারীদের শনাক্ত করার জন্য ড্রোন, সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা, এনটিএমসির মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মোবাইল ট্র্যাকিং করে অবস্থান শনাক্ত করে হত্যা, জখম, গ্রেপ্তার, অন্যায় আটকের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। এই আন্দোলনে আক্রমণকারীরা ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সরকারদলীয় সশস্ত্র ক্যাডার। অপরদিকে আন্দোলনকারীরা ছিলেন সাধারণ, নিরীহ ও নিরস্ত্র ছাত্র-জনতা। এর মাধ্যমে প্রতীয়মাণ হয় যে জুলাই গণ অভ্যুত্থান চলাকালে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা ছিল ব্যাপকমাত্রায় পদ্ধতিগত এবং লক্ষ্যভিত্তিক।
রাজসাক্ষী হিসেবে গত ২ সেপ্টেম্বর ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেন আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তার সাক্ষ্য তুলে ধরে ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেন, গত বছর ১৮ জুলাই শেখ হাসিনার কাছ থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনা আসে। এই সাক্ষী তার স্বীকারোক্তিতে বলেছেন, সেদিন থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর ধারাবাহিকভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। প্রাক্তন ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান এবং ডিবিপ্রধান হারুন-অর-রশীদ বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে প্রাণঘাতী শক্তিপ্রয়োগে বিশেষভাবে উৎসাহী ছিলেন। এরপর থেকে ড্রোন ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের চিহ্নিত করা, হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানো এবং মারণাস্ত্রের ব্যবহার প্রমাণ করে এই অপরাধ ছিল ব্যাপকমাত্রায়, পদ্ধতিগত এবং লক্ষ্যভিত্তিক।
রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, হাত, পা, নাক, চোখ-মুখ, মাথার খুলি হারানো যেসব সাক্ষী ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাদের বাস্তব অবস্থা দেখলে যে কোনো মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক মানসিক অবস্থা ধরে রাখা কঠিন। সংশ্লিষ্ট সাক্ষীসহ নিরীহ-নিরস্ত্র আন্দোলনকারীদের এরকম অবস্থার জন্য দায়ীদের যে কোনো মূল্যে বিচারের আওতায় আনা উচিত। এরপর ট্রাইব্যুনাল রায়ের কার্যকরী অংশ অর্থাৎ সাজা ঘোষণা করেন।
কোন অপরাধে কী সাজা : প্রসিকিউশনের দাখিল করা পাঁচটি অভিযোগ আমলে নিয়ে আসামিদের বিরুদ্ধে ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ গঠন করেছিলেন ট্রাইব্যুনাল। রায় ঘোষণার সময় ট্রাইব্যুনাল জানান, অভিযোগ পুনর্গঠন (রিফ্রেম) করা হয়েছে। অর্থাৎ পাঁচটি অভিযোগকে পুনর্বিন্যাস করে দুইটি অভিযোগে পুনর্গঠন করা হয়েছে।
প্রথম অভিযোগে বলা হয়, ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ বলে উসকানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন শেখ হাসিনা। ওই দিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মাকসুদ কামালের সঙ্গে কথোপকথনে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ বলে উল্লেখ করেন এবং তাদের ফাঁসি দেবেন মর্মে উসকানি ও আদেশ দেন। এ ছাড়া অপরাধ সংঘটনে আসামিরা তার অধীনস্থদের কোনো বাধা প্রদান করেননি। এর ফলে রংপুরে আবু সাঈদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। এই অভিযোগে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইবু্যুনাল।
দ্বিতীয় অভিযোগটি হচ্ছে- ড্রোন ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের অবস্থান নির্ণয়, আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে হেলিকপ্টার এবং মারণাস্ত্র (লেথাল উইপেন) ব্যবহার করে হত্যার নির্দেশ দেওয়া। এর ফলে ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখাঁরপুলে ছয়জনকে হত্যা এবং আশুলিয়ায় ছয়জন আন্দোলনকারীকে হত্যার পর তাদের লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা। এই অভিযোগে শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। দুই অভিযোগেই সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে ৫ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে রায়ে।
সবাই ন্যায়বিচার পেয়েছে : অ্যাটনি জেনারেল : অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি রায় হয়েছে। এই রায়ে শহীদরা ন্যায়বিচার পেয়েছে, রাষ্ট্র ন্যায়বিচার পেয়েছে, প্রসিকিউশন ন্যায়বিচার পেয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি শহীদদের প্রতি, দেশের প্রতি, এ দেশের মানুষের প্রতি, সংবিধানের প্রতি, আইনের শাসনের প্রতি এবং আগামী প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতা পূরণের স্বার্থে এ রায় একটি যুগান্তকারী রায়। এই রায় প্রশান্তি আনবে, এ রায় ভবিষ্যতের জন্য একটি বার্তা। এ রায় বাংলাদেশের ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসনের জন্য একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
রায়ে প্রমাণ হয়েছে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয় : চিফ প্রসিকিউটর : রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের কাছে বলেন, বাংলাদেশ সব আন্তর্জাতিক নর্মস, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড মেনটেইন করে ক্রাইমস অ্যাগেইনস্ট হিউম্যানিটির মতো কমপ্লেক্স অপরাধের বিচার করতে সক্ষম এবং বাংলাদেশ সাফল্যের সঙ্গে সেটা করেছে। রায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, যে ধরনের সাক্ষ্যপ্রমাণ এই আদালতে উপস্থাপিত হয়েছে, বিশ্বের যে কোনো আদালতের স্ট্যান্ডার্ডে এই সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো উতরে যাবে। তিনি বলেন, পৃথিবীর যে কোনো আদালতে এই সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হলে আজকে যেসব আসামিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে তারা প্রত্যেকেই একই শাস্তি প্রাপ্ত হবে।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে দেওয়া রায় প্রতিশোধ নয়, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জাতির প্রতিজ্ঞা। আমি মনে করি, এই রায় কোনোভাবেই অতীতের কোনো কিছুর প্রতিশোধ নয়। এটি ন্যায়বিচারের জন্য যাত্রা। এই রায় প্রমাণ করেছে অপরাধী যত বড় হোক, যত ক্ষমতাশালী হোক, সে আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এ রায়ের ফলে যে ১ হাজার ৪০০ তরতাজা তরুণপ্রাণ দেশে স্বৈরশাসন অবসান করার জন্য জীবন দিয়েছেন, তাদের পরিবারে যদি সামান্য একটু স্বস্তি আসে, সেটাই প্রসিকিউশনের প্রাপ্তি।
আমি কষ্ট পাচ্ছি : রায়ের পর নিজের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন বলেন, আমার ক্লায়েন্টের (হাসিনা-কামাল) বিরুদ্ধে রায়টা ভিন্নভাবে হলেও হতে পারত, কিন্তু হয়নি। এটা আমার বিপক্ষে গেছে, এজন্য আমি কষ্ট পাচ্ছি। কারণ আমার পক্ষে এ মামলায় আপিল করার কোনো সুযোগ নেই।
পলাতক থাকায় আপিল করতে পারবেন না : রায়ের পর প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামীম বলেন, শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল পলাতক থাকায় আপিলের সুযোগ পাবেন না। তিনি বলেন, ট্রাইব্যুনাল আইনে পরিষ্কার বলা আছে, রায় দেওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে আপিল করতে হবে। তবে আপিলের সুযোগ নিতে হলে সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে আত্মসমর্পণ করতে হয়। অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি গ্রেপ্তার করতে পারে, তাহলেও আপিলের সুযোগ পান আসামি।
মামলার পূর্বাপর : গত বছরের ৫ আগস্ট গণ অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। এরপর চলতি বছরের ২৫ মে থেকে ৮ অক্টোবরের মধ্যে মানবতাবিরোধী অপরাধে যেসব মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে, তার মধ্যে জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা মামলা আটটি। এর মধ্যে পাঁচটি মামলায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেছেন ট্রাইব্যুনাল। বিচারাধীন পাঁচটি মামলার মধ্যে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে এ মামলাটি ট্রাইব্যুনালের দ্বিতীয় মামলা।
রক্তক্ষয়ী লাগাতার আন্দোলনে গত বছর ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনা সরকারের। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার। গণ অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে দাবি করে অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দেয়, এ অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করা হবে। ঘোষণা অনুযায়ী পরে ট্রাইব্যুনাল, প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গত বছর ১৭ অক্টোবর দুই মামলার বিষয়ে প্রথম শুনানি হয়। সেদিন প্রসিকিউশনের আবেদনে ট্রাইব্যুনাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। তার আগে গত বছর ১৪ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দাখিল করা হয়। তদন্ত শুরু হয় গত বছর ১৪ অক্টোবর। ছয় মাস ২৮ দিনে তদন্ত শেষ করে এ বছর ১২ মে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। আসামিদের বিরুদ্ধে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলি (ঊর্ধ্বতনের নির্দেশনার দায়), হত্যা, হত্যাচেষ্টা, ব্যাপক মাত্রায় পদ্ধতিগত হত্যা, অপরাধে প্ররোচনা, উসকানি, সহায়তা, সম্পৃক্ততা, ষড়যন্ত্রসহ অন্যান্য অমানবিক আচরণ, সংঘটিত অপরাধ প্রতিহত না করার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়।
গত ১ জুন প্রসিকিউশন ‘আনুষ্ঠানিক অভিযোগ’ দাখিল করলে তা আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে পলাতক শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খাঁনকে আত্মসমর্পণ করতে ১৬ জুন সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেওয়া হয়। পরদিন সেই বিজ্ঞপ্তি দুটি জাতীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। আত্মসমর্পণ না করায় তাদের পলাতক দেখিয়ে গত ১০ জুলাই মামলার অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। তাদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী মো. আমির হোসেনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওইদিন গ্রেপ্তার আসামি সাবেক আইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন এ মামলার রাজসাক্ষী হতে ট্রাইব্যুনালের কাছে আবেদন করেন। পরে তার আবেদন মঞ্জুর করা হয়। গত ৩ আগস্ট চিফ প্রসিকিউটরের সূচনা বক্তব্যের মধ্যদিয়ে শুরু হয় বিচারকাজ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সাক্ষ্য দেন এ মামলায়। রাজসাক্ষী হিসেবে গত ২ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য দেন আসামি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। গত ৮ অক্টোবর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলে ১২ অক্টোবর থেকে শুরু হয় যুক্তিতর্ক। টানা পাঁচ দিন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। গত ১৬ অক্টোবর প্রসিকিউশনের যুক্তিতর্ক শেষ হলে ২০ অক্টোবর থেকে আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক শুরু হয়। রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন টানা তিন দিন শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। সেই ধারাবাহিকতায় গত ২৩ অক্টোবর পাল্টা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে দুই পক্ষই। তার আগে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান ট্রাইব্যুনালে সমাপনী বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
বিচারাধীন আরও তিন মামলা : মানবতাবিরোধী অপরাধে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরও তিনটি মামলা চলছে। ২০১৩ সালের মে মাসে মতিঝিলের শাপলা চত্বরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীদের হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেকটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি করা হয়েছে ২১ জনকে। এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বাড়িয়ে ১২ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনকালে গুমের মাধ্যমে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় করা পৃথক দুটি মামলায় শেখ হাসিনাসহ আসামি ২৮ জন। আসামিদের মধ্যে সাবেক ও বর্তমান ২৩ জন সেনা কর্মকর্তা রয়েছেন। এ দুটি মামলার পরবর্তী শুনানি ২৩ নভেম্বর।