দুর্নীতি এখন জনগণের গলায় ফাঁস হয়েছে। দুর্নীতি এখন দেশের মানুষের কাছে এক নম্বর সমস্যা। জুলাই বিপ্লবের পর এ দেশের মানুষ যে স্বপ্ন দেখেছিল তা আজ ফিকে হয়েছে দুর্নীতির কারণে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, গত দেড় বছরে দুর্নীতি কমেনি। বরং সাধারণ মানুষ মনে করে ঘুষের রেট বেড়েছে। ঘুষবাণিজ্যে অতিষ্ঠ ফুটপাতের হকার থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি পর্যন্ত। সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার সবই তাত্ত্বিক। এসব দিয়ে দুর্নীতি দমন আদৌ সম্ভব কি না সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ নিয়ে যখন জনমনে হতাশা ঠিক তখনই একটি অভিনব উদ্যোগ নিলেন কুমিল্লার জেলা প্রশাসক। বদলির ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধে তিনি এক নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। ঘুষ বা তদবির ছাড়া স্বচ্ছতার মাধ্যমে কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের তৃতীয় শ্রেণির ৫৭ জন কর্মচারীকে বদলি করা হয়েছে। গত ৬ নভেম্বর বৃহস্পতিবার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সবার সামনে লটারির মাধ্যমে এ বদলি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছারের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত লটারিতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাইফুল ইসলাম, এনডিসি ফরিদুল ইসলামসহ অন্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। জেলা প্রশাসন জানান, বদলির ক্ষেত্রে তদবির ও ঘুষের প্রবণতা বন্ধে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। লটারির মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে একজন কর্মচারী নিজেই বক্স থেকে উপজেলার নাম তুলে তার নতুন কর্মস্থল নির্ধারণ করেন। যদিও কয়েকজন কর্মচারী পছন্দের উপজেলায় বদলি না হওয়ায় সামান্য অসন্তোষ প্রকাশ করেন, তবুও অধিকাংশই প্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ ও ন্যায্য বলে মন্তব্য করেন।
অফিস সহকারী প্রতীমা রানী চক্রবর্তী বলেন, চাকরি জীবনে এমন ব্যতিক্রম নিয়ম কখনো দেখিনি, ভালো লেগেছে। দাউদকান্দির উপ-প্রশাসনিক কর্মকর্তা আলমগীর কবির চৌধুরী বলেন, সবার সামনে লটারি হওয়ায় বদলি নিয়ে কোনো পক্ষপাতিত্ব হয়নি।
জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার জানান, দীর্ঘদিন এক স্থানে থাকলে দুর্নীতির ঝুঁকি থাকে, আর বদলি নিয়ে নানা তদবিরও আসে। তাই সবার সমান সুযোগ নিশ্চিতে আমরা লটারির মাধ্যমে বদলির উদ্যোগ নিয়েছি। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে মানবিক বিবেচনায় ছাড় দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও জানান, ধীরে ধীরে অন্য কর্মচারীদেরও একই প্রক্রিয়ায় বদলি করা হবে।
কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের এ উদ্যোগ হতে পারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর কৌশল। সরকারের সেবামূলক সব প্রতিষ্ঠান এ পদ্ধতি অনুসরণ করে বদলি ও পদায়ন করতে পারে। যেমন ধরা যাক, জেলা প্রশাসক পদায়ন নিয়ে প্রায়ই বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যদি ফিট লিস্টে থাকা যোগ্য প্রার্থীদের মধ্যে লটারির মাধ্যমে নির্ধারণ করে যে, কোন জেলায় কে ডিসি পদে নিয়োগ পাবেন তাহলে সহজেই বিতর্ক এড়ানো সম্ভব। একইভাবে সাব রেজিস্ট্রার পদে, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কিংবা চিকিৎসক পদে বদলির ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি একটি সহজ সমাধান।
সব ক্ষেত্রে সমস্যার তাত্ত্বিক সমাধান কাজে আসে না। মাঠপর্যায়ের বাস্তবতার নিরিখে অনেক সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। যেমন কুমিল্লার ঘটনা। আশা করি, সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিয়ে ভাববেন। একটা কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যদি দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারি, তাহলে শেষ পর্যন্ত সব সংস্কার কেবল গবেষণার দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে। বাস্তবে কোনো পরিবর্তন আসবে না। মনে রাখতে হবে, দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারলে, জুলাই বিপ্লব ব্যর্থ হবে। একজন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী যদি ঘুষ না দিয়ে একটি পদে বসেন, তাহলে একদিকে যেমন তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত হবেন না। অন্যদিকে তিনি জবাবদিহির আওতায় আসবেন। ভালো কাজ করে জনগণের আস্থা অর্জন করার চেষ্টা করবেন। এতে দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী আবহ সৃষ্টি হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে দুর্নীতির শতকরা ৬০ ভাগই হচ্ছে সেবা খাতে। যেখানে মানুষ ঘুষ দিয়ে সরকারি সেবা নিচ্ছেন। এটা বন্ধ করতে পারলে দেশের মানুষ উপকৃত হবে। দুর্নীতি কমবে।