মানবিক আদর্শের দীপ্তিতে আলোকিত একটি কল্যাণধর্মী সমাজ প্রতিষ্ঠা ছিল বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়তি জীবনের অন্যতম লক্ষ্য। তিনি গোঁড়ামি, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা, নিপীড়ন, বঞ্চনা, বৈষম্যের শৃঙ্খল ভেঙে মানবাধিকারের মুক্তিবার্তা বহন করেন। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ, ধনী-নির্ধন, প্রভু-ভৃত্য, আমির-ফকিরের জাত্যাভিমানের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। মানবজাতি দেহের ন্যায় এক অখণ্ড সত্তা।
দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যেমন পৃথক করে দেখা যায় না, তেমনিভাবে সমাজে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকেও পরস্পরের তুলনায় খাটো করে দেখা যায় না। কর্মে, ব্যবসায় ও পদমর্যাদায় একজন অপরজন থেকে পৃথক হতে পারে, কিন্তু মানুষ হিসেবে সবার মর্যাদা সমান। মানুষ একে অন্যের ভাই। সব মানুষ আল্লাহর বান্দা।
সবার আদি পিতা আদম (আ.)। মহানবী (সা.) বলেন, ‘সব সৃষ্টি আল্লাহর পরিবারভুক্ত। আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় হচ্ছে ওই ব্যক্তি যে আল্লাহর অপরাপর সৃষ্টিকুলের প্রতি অনুগ্রহ করে।’
(মেশকাত, পৃষ্ঠা-৪২৫)
৬২২ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় হিজরতের অব্যবহিত পরে মহানবী (সা.) পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত বিভিন্ন গোত্র-উপগোত্র ও ধর্মমতের জনগোষ্ঠীকে একই বিধিবদ্ধ আইনের অধীনে আনার জন্য প্রণয়ন করেন ‘মদিনা সনদ’।
সনদের প্রতিটি ধারা পর্যালোচনা করলে মহানবী (সা.)-এর মানবাধিকার ঘোষণার প্রকৃষ্ট পরিচয় প্রতিভাত হয়। ১২১৫ সালের ম্যাগনা কার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইট, ১৬৭৯ সালের হেবিয়াস কর্পাস অ্যাক্ট, ১৬৮৯ সালের বিল অব রাইটস এবং ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ১৪০০ বছর আগে মানবতার ঝাণ্ডাবাহী মহানবী (সা.) সর্বপ্রথম মানুষের আর্থ-সামাজিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকার ঘোষণা করেন। পরস্পরবিরোধী ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে মহানবী (সা.) কর্তৃক সম্পাদিত এ সনদ সমগ্র মানবমণ্ডলী ও অখণ্ড মানবতার এক চূড়ান্ত উত্তরণ।
রাসুলুল্লাহ (সা.) সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে আদর্শ সমাজ গড়ে তোলেন। বংশ কৌলীন্য ও আভিজাত্যের গৌরবের পরিবর্তে মানবতার ভিত্তিতে সমাজের বন্ধন সুদৃঢ় করেন।
তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা দেন, আরবের ওপর অনারবের, অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। সব মানুষ একে অপরের ভাই। সব মানুষ আদমের বংশধর আর আদম মাটি থেকে তৈরি। (আহমদ ইবনে হাম্বল, মুসনাদ, পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪১১; জাহিয, আল বয়ান ওয়াত তিবঈন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন মানুষের মুক্তিবাণী। সমাজজীবনে মানুষ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। বর্ণবৈষম্যের ছোবল থেকে মানবতাকে মুক্ত করার জন্য তিনি ঘোষণা করেন, ‘হে জনগণ! আল্লাহকে ভয় করো। কোনো নাককাটা হাবশি গোলাম তোমাদের আমির নিযুক্ত হলে, তিনি যদি তোমাদের আল্লাহর কিতাব অনুসারে পরিচালিত করেন, তবে তাঁর কথা শুনবে এবং আনুগত্য করবে।’ (তিরমিজি, কিতাবুল জিহাদ, বাবু তা’আতিল ইমাম, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা-২০৯)।
কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস হজরত বেলাল (রা.)-কে মদিনার মসজিদের মোয়াজ্জিন নিয়োগ করে তিনি বর্ণবাদের সমাধি রচনা করেন।
তিনি তাঁর আজাদকৃত গোলাম জায়েদ ইবনে হারিসা (রা.)-এর সঙ্গে আপন ফুপাত বোন জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)-এর বিয়ে সম্পাদন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। এ বিয়ে কোরাইশদের গোত্রীয় আভিজাত্য ও বংশীয় অহংবোধের প্রতি ছিল বিরাট চ্যালেঞ্জ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর এ শিক্ষার ভূমিকা কালজয়ী ও বিশ্বজনীন। এর আবেদন আন্তর্জাতিক ও অসাম্প্র্রদায়িক।
৬৩২ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি বিদায় হজ উপলক্ষে আরাফাত ময়দানে এক লাখ ১৪ হাজার সাহাবার সামনে মহানবী (সা.) যে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন তা মানবিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। সমবেত জনগণের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রাণ, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সম্মান, তোমাদের এই দিনের মর্যাদার ন্যায়, তোমাদের এ মাসের মর্যাদার ন্যায় এবং তোমাদের এ নগরীর মর্যাদার ন্যায়।’
(বোখারি, হাদিস : ১৬৫২)
‘সাবধান! জাহিলিয়াতের সুদ রহিত; প্রথম সুদ, যা আমি রহিত ঘোষণা করছি। আমাদের প্রাপ্য আব্বাস ইবনে আবদুল মোত্তালিবের সুদও সম্পূর্ণই রহিত। মূলধনে তোমাদের অধিকার অব্যাহত থাকবে (যত দিন বেঁচে থাকবে), জুলুম করবে না, তোমরা জুলুম করবে না, জুলুমের শিকারও হবে না।’
(মুসনাদ দারমি, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩২০)
‘সাবধান! অপরাধীই নিজ অপরাধের জন্য দায়ী। সাবধান! পিতার অপরাধের জন্য পুত্র দায়ী নয় এবং পুত্রের অপরাধের জন্য পিতাও দায়ী নয়।’ (তিরমিজি : ৪/৪৬১)
জেনে রাখো, ‘নিশ্চয়ই মুসলমানরা পরস্পর ভাই ভাই, গোটা মুসলিমজগৎ এক অখণ্ড ভ্রাতৃসমাজ। কোনো মুসলমানের সম্পদ তার সন্তুষ্টি ব্যতিরেকে হালাল হয় না। জুলুমের শিকারও হইও না।’
(ইবনে জারির তাবারি, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২০৬)
‘হে জনগণ! সাবধান! দ্বিনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি কোরো না। দ্বিন নিয়ে বাড়াবাড়ির ফলে তোমাদের আগে বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।’ (ইবনে মাজাহ, কিতাবুল মানাসিক, বাবু কাদরি হাসার রামই, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা-১০০৮, নম্বর ৩০২৯)
‘তোমাদের মাতা, তোমাদের পিতা, তোমাদের বোন, তোমাদের ভাই, তোমাদের নিকটাত্মীয় এবং পরবর্তী নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে সদাচরণ করবে।’ (নাসায়ি, কিতাবুজ জাকাত, বাবু আইয়তুহুমাল ইয়াদুল উলয়া, পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬১, নম্বর ২৫৩২)
উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষাপটে আমরা যৌক্তিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় রাসুল (সা.) যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তা ছিল যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক। মদিনায় তার প্রতিষ্ঠিত সমাজকাঠামোতে যে শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছিল পৃথিবীর অন্য কোনো সমাজে তার নজির পাওয়া মুশকিল। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শিক্ষা ও আদর্শের অনুসরণে খুলাফায়ে রাশিদিন যে সমাজব্যবস্থা কায়েম করেন তা ছিল পুরোপুরি মানবতা ও ন্যায়-ইনসাফনির্ভর।
লেখক : ধর্ম উপদেষ্টা