মানুষ মুনাফার জন্য ব্যবসা করে। কিন্তু কখনো কখনো মুনাফার পরিমাণ এত বেশি হয়, যা জনসাধারণের জন্য বহন করা কঠিন হয়ে যায়। তাই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে একজন ব্যবসায়ী কতটা লাভে পণ্য বিক্রি করতে পারবে? এ ক্ষেত্রে ইসলাম কি কোনো সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে? নাকি বিষয়টি ক্রেতা ও বিক্রেতার ওপর ছেড়ে দিয়েছে? নিম্নে এ প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজা হয়েছে।
ব্যবসা ও মুনাফার পরিচয়
ইসলামী পরিভাষায় ব্যবসা হলো কোনো বৈধ পণ্য বৈধ পদ্ধতিতে ক্রয় করে তা বৈধ উপায়ে মুনাফার জন্য বিক্রি করা, শর্ত হলো পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে উভয়ের সম্মতি ও সন্তুষ্টি থাকবে।
আর মুনাফা বলা হয়, মূল্যের সেই অতিরিক্ত অংশ, যা ক্রয়মূল্যের চেয়ে বেশি হয়। শরিয়তে ব্যবসা তথা মুনাফায় পণ্য বিক্রি করা বৈধ। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৭৫)
ব্যবসার উদ্দেশ্যই মুনাফা
ব্যবসা করার মূল উদ্দেশ্যই হলো মুনাফা করা।
পবিত্র কোরআনের আয়াত থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তারাই হেদায়েতের বিনিময়ে ভ্রান্তি ক্রয় করেছে। সুতরাং তাদের ব্যবসা লাভজনক হয়নি, তারা সৎপথেও পরিচালিত নয়।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৬)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা আল্লাহর কিতাব তিলাওয়াত করে, নামাজ আদায় করে, আমি তাদেরকে যে জীবিকা দিয়েছি তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করে এমন ব্যবসার, যার ক্ষয় নেই।’
(সুরা : ফাতির, আয়াত : ২৯)
ব্যবসায় সম্মতি আবশ্যক
পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতি আবশ্যক, বিশেষত যখন তার সঙ্গে বিক্রেতার মুনাফার প্রশ্ন জড়িত থাকে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা একে অপরের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না, কিন্তু তোমাদের পরস্পর সন্তুষ্ট হয়ে ব্যবসা করা বৈধ। আর তোমরা পরস্পরকে হত্যা কোরো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।’(সুরা : নিসা, আয়াত : ২৯)
মুনাফা আল্লাহর অনুগ্রহ
ব্যবসায় মুনাফা করা বা ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকা অনুসন্ধান করাকে আল্লাহ তাঁর অনুগ্রহ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আর আল্লাহর অনুগ্রহ অপরিসীম।
আল্লাহ এ ক্ষেত্রে কোনো সীমা নির্ধারণ করে দেননি। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে, আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফলকাম হও।’ (সুরা : জুমা, আয়াত : ১০)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ কেউ আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধানে দেশভ্রমণ করবে এবং কেউ কেউ আল্লাহর পথে সংগ্রামে লিপ্ত হবে।’ (সুরা : মুজ্জাম্মিল, আয়াত : ২০)
মুনাফার সীমা নির্ধারিত নয়
আল্লামা ইউসুফ আল কারজাভি (রহ.) বলেন, বেশির ভাগ আলেম এ বিষয়ে এক মত যে শরিয়ত ব্যবসা-বাণিজ্যে মুনাফার কোনো সীমা নির্ধারণ করে দেয়নি। সুতরাং একজন ব্যবসায়ী চাইলে ব্যবসায় শতভাগ লাভও করতে পারবে। তবে মালেকি মাজহাবের কোনো ইমাম বলেছেন, লাভের সীমা এক-তৃতীয়াংশে সীমাবদ্ধ থাকা উত্তম। যাঁরা লাভের সীমা নির্ধারিত নয় বলে মত দিয়েছেন, তাঁরা নিম্নোক্ত হাদিস দ্বারা প্রমাণ পেশ করেন। উরওয়া বারিকি (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) একটি বকরি কিনে দেওয়ার জন্য তাঁকে একটি দিনার দিলেন। তিনি ওই দিনার দিয়ে দুটি বকরি কিনলেন। অতঃপর এক দিনার মূল্যে একটি বকরি বিক্রি করে দিলেন এবং নবী (সা.)-এর খিদমতে একটি বকরি ও একটি দিনার নিয়ে উপস্থিত হলেন। তা দেখে তিনি তার ব্যবসা-বাণিজ্যে বরকত হওয়ার জন্য দোয়া করলেন। অতঃপর তার অবস্থা এমন হলো যে ব্যবসার জন্য যদি মাটিও তিনি কিনতেন তাতেও তিনি লাভবান হতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৬৪২)
আছে নৈতিকতার সীমা
ইসলাম ব্যবসায় লাভের আইনত কোনো সীমা নির্ধারণ করে দেয়নি। তবে লাভ নির্ধারণে নৈতিকতার সীমা রয়েছে। প্রাজ্ঞ আলেমরা বলেন, মুনাফা করার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীর উচিত দেশের আর্থিক পরিস্থিতি, সাধারণ মানুষের প্রয়োজন, পণ্যের সরবরাহ ইত্যাদি বিবেচনা করে মুনাফা করা। পণ্য যদি অতি প্রয়োজনীয় হয়; যেমন খাদ্যদ্রব্য—যা ধনী-গরিব সবাইকে কিনতে হয়, তবে ব্যবসায়ীর উচিত এমন পণ্যে অতিরিক্ত লাভ না করা। কেননা এসব পণ্য অসহায় মানুষকে কিনতে হয়। বিপরীতে পণ্য যদি হয় বিলাসসামগ্রী, তবে তাতে অতিরিক্ত লাভের সুযোগ আছে। কেননা ইসলাম মানুষকে বিলাসিতার ব্যাপারে নিরুৎসাহ করে।
লাভের সীমা নির্ধারণ করা
ইসলামের সাধারণ নীতি হলো পণ্য উৎপাদক পণ্যের মূল্য নির্ধারণে স্বাধীনতা ভোগ করবে। সাধারণ অবস্থায় রাষ্ট্র পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করবে না। কেননা পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিলে উৎপাদক পণ্যের মান কমিয়ে দিতে পারে। আনাস (রা.) বলেন, লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসুল (সা.) দ্রব্যের মূল্য বেড়েছে। আপনি আমাদের জন্য মূল্য নির্ধারণ করে দিন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ দ্রব্যমূল্যের গতি নির্ধারণকারী, তিনিই একমাত্র সংকীর্ণতা ও প্রশস্ততা আনয়নকারী এবং তিনি জীবিকা দানকারী। আমি আল্লাহর সঙ্গে এমন অবস্থায় সাক্ষাৎ করতে চাই, যেন তোমাদের কেউ আমার বিরুদ্ধে তার জান ও মালের ব্যাপারে জুলুমের অভিযোগ উত্থাপন করতে না পারে।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৩৪৫১)
তবে বাজারমূল্য যদি অস্বাভাবিক রকম হয় এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়, তবে ইসলাম বাজারদর নিয়ন্ত্রণের অনুমতি দিয়েছে। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেন, ‘মূল্য নির্ধারণ ছাড়া যদি মানুষের কল্যাণ পরিপূর্ণতা লাভ না করে, তাহলে শাসক তাদের জন্য ন্যায়সংগত মূল্য নির্ধারণ করবেন। কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করা বা কারো প্রতি অন্যায় করা যাবে না। আর মূল্য নির্ধারণ ছাড়াই যদি তাদের প্রয়োজন পূরণ হয়ে যায় এবং কল্যাণ সাধিত হয়, তাহলে রাষ্ট্রপ্রধান মূল্য নির্ধারণ করবেন না।’ (কিতাবুল মাজমু : ১২/১২১)
হারাম লাভ
শরিয়ত মানুষকে ব্যবসায় মুনাফা করার স্বাধীনতা দিয়েছে। কিন্তু অর্থ উপার্জনের জন্য হারাম পথ ও পদ্ধতি অবলম্বনের অনুমতি দেয়নি। নিম্নে কয়েকটি হারাম মুনাফার বর্ণনা দেওয়া হলো—
১. হারাম পণ্যের মুনাফা : হারাম পণ্যের ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত লাভ বা অর্থ হারাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ ইহুদিদের ওপর অভিশাপ করুন। তাদের জন্য চর্বি হারাম করা হয়েছিল। তখন তারা তা গলিয়ে বিক্রি করতে লাগল।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৪৬০)
২. প্রতারণার মাধ্যমে মুনাফা : প্রতারণার মাধ্যমে মুনাফা করা নিষিদ্ধ। উকবা বিন আমির (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ(সা.)-কে বলতে শুনেছি, মুসলমান মুসলমানের ভাই। অতএব, কোনো মুসলমানের পক্ষে তাঁর ভাইয়ের কাছে পণ্যের ত্রুটি বর্ণনা না করে তা বিক্রয় করা বৈধ নয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২২৪৬)
৩. মধ্যস্বত্ব ভোগের মাধ্যমে মুনাফা : ইসলাম পণ্য উৎপাদনের পর তা বাজারজাতকরণ পর্যন্ত সময়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছে। এভাবে মুনাফা করা নিষিদ্ধ। আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘আমরা ব্যবসায়ী দলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদের কাছ থেকে খাদ্য ক্রয় করতাম। নবী করিম (সা.) খাদ্যের বাজারে পৌঁছানোর আগে আমাদের তা ক্রয় করতে নিষেধ করলেন।’
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ২১৬৬)
৪. মজুদদারি : বাজারে পণ্যের সংকট থাকার পরও বেশি মুনাফার জন্য পণ্য গুদামজাত করে আটকে রাখা ইসলামে নিষিদ্ধ, বিশেষত তা যদি খাদ্যশস্য হয়। এভাবে মুনাফা অর্জন করা নিষেধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানের খাদ্যশস্য মজুদ রাখে, আল্লাহ তার ওপর দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৫৫)
৫. বাজার সিন্ডিকেট : ইসলামের নির্দেশনা হলো পণ্য উৎপাদনের পর তা স্বাধীনভাবে বাজারে প্রবেশ করবে। বাজারমূল্য বৃদ্ধির জন্য তা আটকে রাখবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার রাখে সে আল্লাহর জিম্মা থেকে বেরিয়ে যায়।’
(মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ২০৩৯৬)
৬. কালোবাজারি : কালোবাজারি সরাসরি প্রতারণা, জুলুম ও আর্থিক অসততার শামিল। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনরা! তোমরা নিজেরা নিজেদের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ কোরো না।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৮)
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন