এবার ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল চলে এলো ঢাকায়। গতকাল রাজধানীর বাড্ডায় সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৫ সেকেন্ডে উৎপন্ন হওয়া ভূকম্পনটির রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৭। এর ঠিক এক সেকেন্ড আগে সন্ধ্যা ৬টা ৬ মিনিট ৪ সেকেন্ডে ৪ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয় নরসিংদীতে। সকালে নরসিংদীর পলাশে ৩ দশমিক ৩ মাত্রার আরও একটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। গতকাল দেশে সাড়ে সাত ঘণ্টার ব্যবধানে তিনবার ভূকম্পন অনুভূত হওয়ার খবর দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
আবহাওয়া অধিদপ্তর ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশে আরও ভয়াবহ ভূমিকম্পের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। একের পর এক ছোট ছোট ভূমিকম্প যেগুলো হচ্ছে, তাকে ‘ফোরশক’ বলে। ফোরশক বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি করে। যদি পরবর্তী চার থেকে পাঁচ দিন এই ফোরশকগুলো আরও হয় তখন বড় ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। সাধারণত ১৫ থেকে ২০টি ফোরশক হলেই বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি হয়। এ ক্ষেত্রে এবার ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়, তাহলে এক থেকে তিন লাখ মানুষ হতাহত হতে পারে এবং শহরের প্রায় ৩৫ শতাংশ ভবন ধসে পড়ার আশঙ্কা আছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান রুবাইয়াত কবির বলেন, শুক্রবারের ভূমিকম্পের আফটার শক হিসেবে নরসিংদীর পলাশে গতকাল শনিবার আবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। সাধারণত আফটার শক কয়েক সপ্তাহ থেকে মাস খানেক পর্যন্ত হতে পারে। একটি ভূমিকম্প হলে প্রথম কয়েক দিনের মধ্যে আফটার শক অনুভূত হয়। বাংলাদেশের যে ভৌগোলিকগত অবস্থান, সেই বিবেচনায় এবং ইতিহাস বিবেচনায় বাংলাদেশ এবং চারপাশে অনেক বড় ভূমিকম্প হয়েছে। এই বিষয়গুলো হিসাবে নিলে ২১ নভেম্বরের চেয়েও বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা আছে। ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। আজ থেকে ২০০ বছর আগে এই অঞ্চলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। সুতরাং এই অঞ্চলে আবারও বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। ইতিহাস বলছে, আমাদের এই অঞ্চলে সাড়ে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে। এই বিবেচনায় আমরা ধারণা করছি- দেশের যে এলাকায় আগে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে, সেখানে বা তার আশপাশে বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা আছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ মেহেদী আহমেদ আনসারী গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুক্রবার এবং গতকাল শনিবার যে ভূমিকম্প দেশে অনুভূত হয়েছে, এগুলো ‘ফোরশক’। ৫ দশমিক ৭ মাত্রা এবং ৩ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প বড় নয়। একটি বড় ভূমিকম্প হওয়ার আগে এ ধরনের ছোট ছোট ভূমিকম্প হয়। এই ভূমিকম্পগুলো থেকে একটি বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। সাধারণত ৭ মাত্রার ভূমিকম্পকে বড় বলে থাকি। আমাদের এখানে একটি ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা সব সময়ই ছিল। একে বলে প্লেট বাউন্ডারি ২। এই বাউন্ডারিতে এখন বড় ধরনের ভূমিকম্প তৈরি হতে পারে। এজন্য আগামী দুই থেকে তিন দিন আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। যদি আরও ছোট ছোট ভূমিকম্প বা ফোরশক হয় তখন বড় মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। এই ফোরশকগুলো থেকে ৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হতে পারে। যদি পরবর্তী ৪ থেকে ৫ দিন এই ফোরশকগুলো হয়, তখন বড় ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। সাধারণত ১৫ থেকে ২০টি ফোরশক হলে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি তৈরি হয়। যেহেতু বাংলাদেশের ইতিহাস বলছে, এর আগেও এখানে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছে; সে হিসেবে এখানে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা আছে। আমরা এখন বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছি।
তথ্য বলছে, সাধারণত ১০০ থেকে ১৫০ বছর পরপর ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। আর ২৫০ থেকে ৩০০ বছর পরপর ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকি থাকে। মেহেদী আহমেদ আনসারী জানান, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১৮৬৯ থেকে ১৯১৮ সালের মধ্যে ৭ থেকে ৮ মাত্রার ওপর ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এগুলো হচ্ছে কাছাড় ভূমিকম্প, বেঙ্গল ভূমিকম্প ও গ্রেট ইন্ডিয়ান ভূমিকম্প। ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়।
নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দুই বছর আগের রিপোর্ট বলছে, মধুপুর ফল্টে যদি ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে সাড়ে ৮ লাখের ওপর ভবন ধসে পড়বে। এতে শুধু ঢাকায় ২ লাখের বেশি প্রাণহানি ঘটবে। তুরস্কে ৭ মাত্রার ওপর ভূমিকম্পে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। আবার হাইতির মতো স্বল্প আয়ের দেশে কয়েক লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। ঢাকায় জনঘনত্ব হাইতির চেয়েও বেশি। নির্দ্বিধায় বলা যায়, ৭ মাত্রায় ভূমিকম্প হলে ঢাকায় লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হবে।
২১ নভেম্বরের চেয়ে যদি আরও বেশি সময় ধরে ভূমিকম্প হয় তাহলে কয়েক লাখ ভবন ধসে পড়তে পারে। লাখ লাখ মানুষ বিল্ডিং কোড মেনে তৈরি করা ভবনে থাকে না। এতে ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়বে এবং আমাদের অবস্থাও খুব একটা ভালো নেই। বড় ধরনের ভূমিকম্প সামলানোর প্রস্তুতি হিসেবে সরকারকে এখনই শুক্রবার ভূমিকম্পে যে ভবনগুলোতে ফাটল দেখা দিয়েছে এবং হেলে পড়েছে সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। ওয়ার্ডভিত্তিক উচ্চ ও মাঝারি ঝুঁকির ভবনগুলো চিহ্নিত করতে হবে। যে ভবনগুলো রেট্রোফিটিং করা সম্ভব সেগুলো করতে হবে। জলাশয় ভরাট করে এবং নিয়ম ভেঙে যে ভবন তৈরি করা হয়েছে সে ভবন মালিক ও নির্মাতাদের আইনের আওতায় আনতে হবে।