মহান আল্লাহর সর্বোত্তম সৃষ্টি মানুষ। আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ কর, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বলেন, আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি সৃষ্টি করব।’ (সুরা বাকারাহ : আয়াত ৩৫) মানুষ হচ্ছে আল্লাহর ‘খলিফা’ (প্রতিনিধি)। কিন্তু জীবাত্মার প্ররোচনায় পড়ে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। জীবাত্মা ষড়রিপু দ্বারা বেষ্টিত থাকে। ‘ষড়’ শব্দের অর্থ ছয়, আর ‘রিপু’ অর্থ শত্রু বা কণ্টক। ষড়রিপু মানব চরিত্রের ছয়টি প্রবৃত্তি, যথা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য। ষড়রিপুর অসংযমী ব্যবহারে মানুষ মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলে। আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি সৃষ্টি করেছি জাহান্নামের জন্য এমন অনেক জিন ও মানুষ, যাদের অন্তর আছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে তারা বোঝে না, তাদের চোখ আছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না এবং তাদের কান আছে বটে, কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর ন্যায়, বরং তারা তার চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই গাফেল বা উদাসীন।’ (সুরা আ’রাফ : আয়াত ১৭৯) এই আয়াতে ষড়রিপুর দ্বারা আক্রান্ত মানুষকে পশুর ন্যায় অভিহিত করা হয়েছে।
কামের আভিধানিক অর্থ কামনা, বাসনা, আসঙ্গ, লিপ্সা। কামের প্রতিশব্দ হলো সম্ভোগের ইচ্ছা। মানুষের মাঝে বিদ্যমান সবকিছুই আল্লাহ প্রয়োজনে দিয়েছেন। কামশক্তি মানবজীবনের জন্য অপরিহার্য। এটি না থাকলে পৃথিবীতে মানুষের বংশ বৃদ্ধি হতো না। কামের ব্যবহার অবশ্যই নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত কামের প্রভাবে মানুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। ফলে অশান্তির দাবানলে পারিবারিক জীবন হয়ে ওঠে দুর্বিষহ। এমতাবস্থায় মানুষ হত্যার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটিয়ে থাকে। পিতা-মাতার দ্বারা নিষ্পাপ শিশু সন্তানও খুন হচ্ছে অহরহ। কামরিপুর ধোঁকায় পড়ে মানবজীবনে বিপর্যয় ঘটে। পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ব্যভিচারী ব্যক্তি অবিশ্বাস, কলঙ্ক, অসম্মান, নিন্দা ও ভর্ৎসনায় পতিত হয়। কাম হলো নরকের দ্বার। কামরিপু মানুষকে ধর্মচর্চায় বাধা দিয়ে নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় ঘটায়। চরিত্রহীন ব্যক্তি আল্লাহর আরাধনায় মগ্ন না হয়ে কামরিপুর অশ্লীল সুখানুভূতিতে মত্ত থাকে। অশুদ্ধ চিন্তায় কামরিপু শক্তিশালী হয়ে মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। ষড়রিপুর মধ্যে কাম সর্বাপেক্ষা ভয়ংকর রিপু। অন্যান্য রিপুকে কামরিপু প্রভাবিত করে। কামের প্রভাবে সেই রিপুগুলো মানুষকে নেতিবাচক কর্মকান্ডের দিকে ধাবিত করে। কামরিপু নিয়ন্ত্রিত না হলে অসামাজিক কার্যকলাপে গোটা সমাজ কলুষিত বা দূষিত হয়ে পড়ে। নফসে আম্মারা (জীবাত্মা) শয়তানের কাজ করে। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই নফসে আম্মারা (মানুষের জীবাত্মা) মন্দ কাজেরই প্ররোচনা দিয়ে থাকে।’ (সুরা ইউসুফ : আয়াত ৫৩) হজরত রসুল (সা.) বলেন, ‘প্রতিটি মানুষের কলবে দুটি কক্ষ রয়েছে। তার একটিতে শয়তানের অবস্থান, আর কলবের অন্য কক্ষটিতে ফেরেশতার অবস্থান। মানুষের কলবে যখন আল্লাহর জিকির জারি হয়, তখন শয়তান তার থেকে দূরে সরে যায়। আর সে যখন আল্লাহর জিকির থেকে বিরত হয়, তখন শয়তান কলবের ভিতর কুমন্ত্রণা দিয়ে থাকে।’ (তাফসিরে মাজহারি, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৬৮) কলব বা হৃদয় থেকে শয়তানকে বিতাড়িত করার জন্য আত্মশুদ্ধি ও কলবে আল্লাহর জিকির জারি করা প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে যে আত্মশুদ্ধি লাভ করে।’ (সুরা আল আ’লা: আয়াত ১৪) আল্লাহ আরও বলেন, ‘যারা ইমান আনে এবং আল্লাহর জিকিরে যাদের কলব প্রশান্তি লাভ করে; জেনে রেখ আল্লাহর জিকিরেই কেবল কলব প্রশান্তি লাভ করে।’ (সুরা আর রা’দ : আয়াত ২৮)
মানুষ কলবে জিকির জারির মাধ্যমে কামসহ অন্যান্য রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কামকে বিশুদ্ধ প্রেমে রূপান্তর করতে পারলে, সেই প্রেম স্রষ্টাকে পাওয়ার বাসনায় নিমগ্ন হয়। এজন্য প্রয়োজন ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে জাগ্রত করা। ধর্মীয় ও নৈতিকতার সঠিক অনুশীলন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে কামরিপু নিয়ন্ত্রণে সফলতা অর্জিত হয়। কাম নিয়ন্ত্রণের জন্য আল্লাহতত্ত্বের জ্ঞানী অলি-আল্লাহর সান্নিধ্যে গিয়ে গভীর সাধনায় আত্মনিয়োগ করা অত্যাবশ্যক। কামরিপুর সঠিক প্রয়োগ বিবাহিত জীবনে সুখ ও শান্তি বয়ে নিয়ে আসে। আল্লাহ বলেন, ‘আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে অন্যতম এই যে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের নিজেদের মধ্য থেকে স্ত্রীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি লাভ কর এবং সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া।’ (সুরা আর রুম : আয়াত ২১) স্বামী ও স্ত্রীর পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসায় জীবন হয়ে ওঠে স্বর্গ। পর নারী ও পরপুরুষের প্রতি আসক্তি জীবনকে নরক বানিয়ে দেয়। একটি সুখময় পৃথিবী গড়ে তোলার জন্য কামরিপুকে নিয়ন্ত্রণ করে বিশুদ্ধ প্রেমকে জাগ্রত করতে হবে। সাধক কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেন, ‘কামনা আর প্রেম দুটি হচ্ছে সম্পূর্ণ আলাদা। কামনা একটি প্রবল সাময়িক উত্তেজনা মাত্র, আর প্রেম হচ্ছে ধীর, প্রশান্ত ও চিরন্তন।
♦ লেখক : গবেষক, কদর রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন্স