বাংলাদেশকে বাণিজ্যিক হাব হিসেবে গড়ে তুলতে এবং তার লজিস্টিক সক্ষমতাকে বৈশ্বিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিকোণ হলো বন্দর ও কনটেইনার টার্মিনালগুলোর আধুনিকায়ন। সাম্প্রতিক সময়ে গৃহীত দুইটি চুক্তি- চট্টগ্রামের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল ও ঢাকার পানগাঁও ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল (PICT)- দেশের লজিস্টিক নকশায় একটি কৌশলগত মোড় ঘোরিয়েছে। একটি গোষ্ঠী এই সিদ্ধান্তকে “দেশীয় সম্পদ বিদেশি আধিপত্যবাদে তুলে দেওয়া” হিসেবে সমালোচনা করলেও, অন্য গোষ্ঠী এটিকে এক যুগোপযোগী অংশীদারিত্ব এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের একটি সুযোগ হিসেবে দেখেছে। এই প্রবন্ধে আমি উভয় দৃষ্টিকোণ বিশ্লেষণ করবো, চুক্তির সক্ষমতা ও সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করব, এবং সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া একসাথে মিশিয়ে একটি স্পষ্ট ও যুক্তিপূর্ণ মূল্যায়ন উপস্থাপন করবো।
বাংলাদেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা ইতিহাস দীর্ঘ এবং জটিল। চট্টগ্রাম বন্দর, দেশের সব থেকে ব্যস্ত বন্দর হিসেবে, বহু বছর ধরেই যান্ত্রিক ও প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জের মুখে এসেছে। পুরাতন টার্মিনালগুলোর সঙ্গে কর্মক্ষমতা সীমিত, অপর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, উচ্চ অপারেশনাল খরচ এবং দেরিতে কন্টেইনার খালাস এমন বাধা তৈরি করেছিল যা বাজার প্রতিযোগিতায় দেশকে অবণমূলিত করছিল। আমদানি-রপ্তানিকারকরা প্রায়ই বিলম্ব অনুভব করতেন; জাহাজ অপেক্ষায় থাকতে হতো এবং প্রতিক্রিয়া সময় দীর্ঘ হওয়ায় খরচ বাড়তো। একদিকে, এই সব সমস্যা দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছিল, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনগুলো বাংলাদেশের প্রতি তাদের অগ্রাধিকার কমিয়ে দিচ্ছিল।
ঢাকার নিকটবর্তী পানগাঁও ইনল্যান্ড কনটেইনার টার্মিনাল (PICT) প্রকল্পটি মূলত এই সমাধানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার উদ্দেশ্যে গড়ে তুলেছিল। অনুমান করা হয়েছিল যে একটি ইনল্যান্ড টার্মিনাল নদীপথ ও রাস্তাপথের সমন্বয় করে ঢাকার শিল্প অঞ্চল ও রফতানিকারীদের জন্য একটি কার্যকর এবং সাশ্রয়ী পথ সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু বাস্তবায়নে দেখা যায়, পর্যাপ্ত ইনভেস্টমেন্ট, প্রযুক্তি ও পরিচালন দক্ষতার অভাব, গুদাম ও স্টোরেজ সীমাবদ্ধতা এবং কার্যকর মাল্টি-মোডাল সংযোগ না থাকার কারণে PICT তার পুরো সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারেনি। ট্রাকিং বোঝার চাপ অব্যাহত ছিল, এবং নদীপথ সংযোগ ও বার্জ অপারেশন পরিকল্পনাগুলোর বাস্তবায়ন সর্বদা জটিলতার মুখোমুখি হয়।
এই পটভূমিতে বাংলাদেশ সরকার- গ্লোবাল অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তি আনার জন্য বিদেশি অপারেটরের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্ব গঠন করার স্ট্র্যাটেজিক সিদ্ধান্ত নেয়। সেই আলোকেই পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ/কনসেশন মডেল নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়, যেখানে বিদেশি কোম্পানিগুলো অপারেশনাল দায়িত্ব নেবে, কিন্তু মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ সরকারের কন্ট্রোলে থাকবে। এর ফলে বাংলাদেশের বন্দরব্যবস্থা দ্রুত গতিতে আধুনিক হতে পারে, এবং লজিস্টিক গতি, দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক সংযোগ বৃদ্ধি পায়।
লালদিয়া কন্টেইনার টার্মিনালের ক্ষেত্রে APM Terminals B.V. (Maersk গ্রুপ) কে ৩০ বছরের কনসেশন প্রদান করা হয়েছে। এই চুক্তি কেবল অপারেশনাল দায়িত্বই নয় বরং এটি একটি বিশাল বিনিয়োগ পরিকল্পনা। APM প্রায় ৫৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে- যা টার্মিনাল নির্মাণ থেকে শুরু করে সমস্ত ব্যবস্থাপনাকে অন্তর্ভুক্ত করে। এই প্রকল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিপূর্ণভাবে পারিপার্শ্বিক এবং সাসটেইনেবল পোর্ট গঠন করা হবে, যেখানে নতুন কনটেইনার ক্রেন এবং বড় জাহাজ (প্রায় ৬,০০০ TEU পর্যন্ত) অবতরণ করতে পারবে। নতুন অপারেশন ২৪ ঘণ্টা কাজ করবে, রাত্রিকালীন ন্যাভিগেশন সুবিধা থাকবে এবং পরিবেশ সচেতন প্রযুক্তি যেমন সোলার প্যানেল, শোর‑পাওয়ার সিস্টেম ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, APM প্রথম ধাপে বার্ষিক প্রায় ৮০০,০০০ TEU হ্যান্ডলিং সক্ষমতা আনবে এবং ভবিষ্যতে সক্ষমতা বাড়িয়ে ১০ লাখ TEU-এ শীর্ষে নিয়ে যেতে পারবে। এটি স্পষ্টভাবে চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা ও পরিসরের গতি পরিবর্তন করতে পারে এবং আন্তর্জাতিক শিপিং লাইনের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
চুক্তির আরেকটি সুগভীর দিক‑রাজস্ব ভাগাভাগি। APM এবং CPA-এর মধ্যে একটি মডেল নির্ধারিত হয়েছে যেখানে APM TEU‑ভিত্তিক ফি প্রদান করবে। যেমন, প্রথম ধাপে পর TEU-র জন্য ২১ ডলার /TEU প্রদান করার চুক্তি হয়েছে, এবং ভলিউম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফি গঠন সমন্বয়যোগ্য। এ ছাড়া, পারফরম্যান্স-ভিত্তিক গ্যারান্টি আছে- APM যদি নির্ধারিত ভলিউম অর্জন করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে মিনিমাম ভলিউম পেমেন্ট করতে হবে, যা সরকারের জন্য এক ধরনের নিরাপত্তা সুরক্ষা হিসেবে কাজ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- চুক্তি শেষে পুরো অবকাঠামো ফেরত দেওয়া হবে; অর্থাৎ মালিকানা পুরোপুরি CPA হাতে ফিরে আসবে।
পানগাঁও ইনল্যান্ড টার্মিনালের ক্ষেত্রে, Medlog SA (MSC গ্রুপ) কে ২২ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে। এই লিজ শুধু পরিচালন দায়িত্ব নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত লজিস্টিক চেইন গঠনের পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত করে। Medlog ১৬০,০০০ TEU বার্ষিক সক্ষমতা অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করছে -যা বর্তমান রিপোর্ট করা সক্ষমতা (প্রায় ১১৬,০০০ TEU) থেকে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। তাদের বিনিয়োগ পরিকল্পনায় রয়েছে নতুন মোবাইল হার্বার ক্রেন, ২৪ ঘণ্টার বিদ্যুৎ, রিফার সংযুক্তি, খালি কনটেইনার স্টোরেজ, মেরামত ইয়্যার্ড এবং প্রায় ১০,০০০ বর্গমিটার আকারের কনটেইনার ফ্রেইট স্টেশন (CFS)। সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো তাদের বার্জ অপারেশন পরিকল্পনা- Medlog নদীপথ ব্যবহার করবে বার্জ ধরনের রিভার ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম, যা টার্মিনাল থেকে সমুদ্র বন্দর বা অন্য নদীতীরবর্তী লজিস্টিক কেন্দ্রে পণ্য পরিবহন করবে। এটি ইনল্যান্ড ও সমুদ্রপথকে একত্রিত করে একটি কার্যকর “মাল্টি-মোডাল” লজিস্টিক শৃঙ্খলা তৈরির সুযোগ দেয়, যা ট্রানজিট সময় কমাতে এবং পরিবহন ব্যয় হ্রাস করতে সহায়ক হবে।
বাংলাদেশের অনেকে এই চুক্তিকে “বিদেশি আধিপত্যবাদ” হিসেবে দেখছেন, যেখানে তারা মনে করেন দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত সম্পদ বিদেশি হাতেও চলে যাচ্ছে। তাদের যুক্তি হলো- দীর্ঘমেয়াদী অপারেশনাল দায়িত্ব দেশকে বিদেশি কোম্পানির উপর নির্ভরশীল করে দেবে এবং একদিন এই স্বার্থপর অংশীদাররা দেশের স্বতন্ত্র নীতিনির্ধারণ বা জাতীয় স্বার্থকে কার্যকরভাবে প্রভাবিত করতে পারবে। এমন চিন্তা রাজনৈতিকভাবে চিন্তাসরূপ উঠে আসে- বিশেষ করে জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা দৃষ্টিকোণ থেকে।
তবে এই সমালোচনার বহু অংশ একদৃষ্টিকোণমূলক। প্রথমত, মালিকানা পুরোপুরি হস্তান্তর করা হচ্ছে না বরং সরকারের (CPA) হাতে স্বত্ব রয়ে গেছে, এবং চুক্তি শেষে অবকাঠামো সরাসরি সরকারের হাতে ফিরে আসবে। এটি এক “দায়িত্ব ভাগ করা কিন্তু সম্পদ রক্ষা করা” মডেল। দ্বিতীয়ত, গ্যারান্টি এবং পারফরম্যান্স শর্তাবলী চুক্তিতে স্পষ্টভাবে যুক্ত করা আছে- মিনিমাম ভলিউম গ্যারান্টি, রাজস্ব ভাগাভাগি এবং পুনর্বিবেচনা/নবায়ন ধারা দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করে। এই ধরনের কাঠামো প্রমাণ করে যে অংশীদারিত্ব একরূপ নয়, বরং পারস্পরিক দায়িত্ব ও স্বার্থে ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে।
তৃতীয়ত, প্রযুক্তি স্থানান্তর ও দক্ষতা গড়ার প্রতিশ্রুতি চুক্তিতে একটি কেন্দ্রীয় উপাদান। APM এবং Medlog– উভয়েই স্থানীয় লজিস্টিক কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেবে, ডিজিটাল অপারেশন এবং মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন করবে, এবং স্থানীয় পরিচালন ক্ষমতা গড়ার জন্য কাজ করবে। এটি একটি একদিকের অভ্যন্তরীণ “দাসত্ব” নয়, বরং সক্ষমতা গড়ার একটি প্রগতিশীল উৎস।
এটা ঠিক যে, দীর্ঘমেয়াদী অংশীদারিত্ব গঠনের সময় জনসাধারণ ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর অংশগ্রহণ এবং আরও প্রকাশ্য আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে দ্রুত সিদ্ধান্ত মানেই নেতিবাচকতা নয়, যদি সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়ে পারফরম্যান্স, পালাবদলি ও মনিটরিং মেকানিজম সুনির্দিষ্ট হয় এবং নিয়মিত মূল্যায়ন সুনিশ্চিত করা হয়। সুতরাং যুক্তিসমত পথ হলো স্বচ্ছতা এবং অংশগ্রহণ বৃদ্ধির দিকে সরকার ও অপারেটরদের আরও মনোনিবেশ করা। সরকারকে পারফরম্যান্স মাপক (KPIs) নির্ধারণ করতে হবে, নিয়মিত অডিট এবং মূল্যায়ন প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে, এবং স্থানীয় অংশীদারদের অংশগ্রহণ ও সক্ষমতা উন্নয়নের পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করা উচিত। এভাবে, অংশীদারিত্ব এক‑চাপের সম্পর্কের পরিবর্তে একটি গতিশীল এবং দ্বি-মুখী সংলাপ ও সহ-উন্নয়ন মডেলে পরিণত হবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, লালদিয়া টার্মিনাল যদি তার পুরো পরিকল্পিত সক্ষমতায় কাজ শুরু করতে পারে, বার্ষিক প্রায় ৮ লাখ TEU অতিরিক্ত ব্যাবহার আনতে পারবে। এটি বর্তমান চট্টগ্রাম বন্দরের অপারেশনাল চাপ হ্রাস করবে এবং বড় জাহাজগুলোর জন্য উন্মুক্ত নতুন পথ তৈরি করবে। বড় জাহাজ ব্যবহার করতে পারলে প্রতিটি কনটেইনারের জন্য ব্যয় কমে আসতে পারে, কারণ জাহাজকে লম্বা সময়ে অপেক্ষা করতে হবে না এবং প্রতিলিপি ও খালাস প্রক্রিয়া দ্রুত হবে। এর ফলে আমদানি- রফতানিকারকদের জন্য প্রবাহ খরচ কমতে পারে, যা দেশের পুরো সরবরাহ চেইনকে আরও প্রতিযোগিতামূলক করবে।
নতুন অবকাঠামোর কারণে কর্মসংস্থানে বড় সুযোগ তৈরি হবে। নির্মাণ পর্যায়ে হাজারো কর্মের সম্ভাবনা থাকবে পাশাপাশি অপারেশন পর্বে স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। অর্থোপার্জন বাড়ার পাশাপাশি এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক গতি লাগিয়ে দেবে, বিশেষ করে বন্দরের আশপাশের এলাকায় বাসিন্দাদের জন্য। APM‑CPA অংশীদারিত্ব মডেলে TEU‑ভিত্তিক ফি এবং পারফরম্যান্স ভিত্তিক গ্যারান্টি সরকারকে দীর্ঘমেয়াদী আয়ের উৎস দেবে। এই আয়কে দেশের অন্যান্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পে পুনরায় বিনিয়োগ করা যেতে পারবে।
পানগাঁও ক্ষেত্রে, Medlog এর পরিকল্পিত সক্ষমতা বৃদ্ধি (প্রায় ১৬০,০০০ TEU) এবং বার্জ অপারেশন মডেল একটি কাঠামোগত পরিবর্তন আনে। নদীপথ এবং ইনল্যান্ড লজিস্টিকের আরও কার্যকর ব্যবহার, রপ্তানিকারক ও আমদানিকারকদের জন্য নতুন গতি এনে দেবে। ট্রাকিং চাপ কমে আসার ফলে পরিবহন ব্যয় হ্রাস পাবে এবং সময় সংকুচিত হবে, যা দেশের শিল্প ও রফতানি কেন্দ্রগুলোর জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান করবে। এই ধরনের মাল্টি-মো তুলনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বিবেচনা করলে, যদি এই দুটি টার্মিনাল পুরোপুরি দেশীয় প্রতিষ্ঠান দ্বারা পরিচালিত হত, তাহলে টার্মিনালের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থানে দেশীয় সকল অংশগ্রহণ ও রাজস্ব পুরোপুরি স্থানীয় হতো। তবে, স্থানীয় কোম্পানিগুলোর জন্য এই রকম বিশাল বিনিয়োগ উত্তোলন একসাথে করা কঠিন হতে পারতো, বিশেষত দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি ও প্রযুক্তিগত অস্পষ্টতার কারণে। অপারেটিং দক্ষতা, পরিচালন মাপদণ্ড, অটোমেশন এবং বড় জাহাজ পরিচালনায় অভিজ্ঞতার অভাব স্থানীয় অপারেটরদের জন্য একটি বড় বাধা হতে পারত। এছাড়াও, দীর্ঘমেয়াদে পারফরম্যান্স এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে দেরি হলে, রাজস্ব প্রবাহ ও প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান বিদেশি অপারেটরের তুলনায় অনেক ধীর গতি পেত।
সুতরাং বর্তমান চুক্তি কাঠামো- যেখানে বিদেশি অপারেটর দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তি এবং গ্লোবাল নেটওয়ার্ক নিয়ে আসে, এবং সরকার মালিকানা, নিয়ন্ত্রণ ও রাজস্ব ভাগ রক্ষা করে- একটি যৌক্তিক ও প্রগতিশীল সমাধান হিসেবে দাঁড়ায়। যদিও সমালোচকরা তাবেদারি বা আধিপত্যবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বিগ্ন, কিন্তু বাস্তবতা হলো, পারস্পরিক দায়িত্ব, স্বচ্ছতা ও পরিবর্ধন‑শর্তাবলী এই অংশীদারিত্বকে দেশের স্বার্থে রূপান্তর করার সুড়ঙ্গ তৈরি করে।
ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপটে, একটি বাস্তব রোডম্যাপ অপরিহার্য। সরকারের পাশাপাশি অপারেটরদের উচিত স্থানীয় এবং জাতীয় লজিস্টিক, ইঞ্জিনিয়ারিং, মানবসম্পদ ও ব্যবস্থাপনার সংস্থা গুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি পরিকল্পনা তৈরি করা। অংশীদারি ফোরাম গঠন করা যেতে পারে যেখানে স্থানীয় অংশীদার, নীতিনির্ধারক, শ্রমশক্তি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান নিয়মিত অংশগ্রহণ করে পারফরম্যান্স, উন্নয়ন এবং শর্তাবলী পর্যালোচনা করতে পারে। এমন একটি পথ গঠন করা উচিত যেখানে দেশীয় অংশীদাররা ধাপে ধাপে সক্ষমতা অর্জন করে, যাতে ভবিষ্যতে তারা সর্বোচ্চ দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে, এবং দেশের স্বনির্ভরতা বাড়ে।
শেষ পর্যন্ত বলা যায়, লালদিয়া ও পানগাঁও টার্মিনাল চুক্তি শুধুমাত্র অবকাঠামোগত বিনিয়োগ নয়, বরং এটি বাংলাদেশের লজিস্টিক ভবিষ্যতের জন্য এক কৌশলগত পদক্ষেপ। এটি অংশীদারিত্ব, দক্ষতা, গতি এবং স্থায়ীত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার একটি প্রমাণ। যদিও সমালোচনা এবং উদ্বেগ স্বাভাবিক ও যুক্তিসমত, তবে চুক্তির কাঠামো, শর্তাবলী ও অংশীদারি দৃষ্টিকোণ যেভাবে গঠন করা হয়েছে, তা দেশের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থকে নিরাপদ রাখে এবং গ্লোবাল লজিস্টিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে শক্তিশালী প্রতিযোগী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার সম্ভাবনা বহুগুণ বাড়ায়। এই চুক্তিগুলোর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন, নিয়মিত মনিটরিং এবং স্থানীয় সক্ষমতা গড়ার মাধ্যমে, বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী, গতিশীল ও প্রতিযোগিতামূলক বন্দর ও লজিস্টিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারে- যা শুধুমাত্র আজকের দিনের জন্য নয়, আগামী প্রজন্মগুলোর জন্যও এক স্থায়ী গুণগত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
[email protected]