২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অনিয়ম তদন্তে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের জেরা করছে এ নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিশন। এ পর্যন্ত ২০ জনের বেশি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
এ তালিকায় রয়েছেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক ও দুটি গোয়েন্দা সংস্থার কয়েক কর্মকর্তাসহ আরও অনেকে। এদের মধ্যে যারা কারাগারে আটক রয়েছেন তাদের কারাগারে গিয়ে জেরা করা হয়েছে। চলতি মাসের প্রথম দিকে কমিশনের জেরার মুখে পড়েন কেরানীগঞ্জ কারাগারে আটক থাকা সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। চলতি সপ্তাহে তাকে দ্বিতীয়বারের মতো জেরা করবে কমিশন। অন্যদিকে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এরই মধ্যে জেরা শেষ করেছে কমিশন। চলতি মাসের ৩০ তারিখে কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়ার কথা। তবে কমিশনের মেয়াদ আরও কয়েক দিন বাড়তে পারে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
নির্বাচন তদন্ত কমিশন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব তথ্য জানিয়ে বলেন, ২৭ নভেম্বরের মধ্যে কমিশন তাদের তদন্ত শেষ করতে চায়। এর অংশ হিসেবে ২৬ নভেম্বর কমিশনের সদস্য আইনজীবী তাজরিয়ান আকরাম হোসাইন যাবেন খুলনায়। অন্যদিকে ২৭ নভেম্বর কমিশন প্রধান হাই কোর্টের সাবেক বিচারপতি শামীম হাসনাইন যাবেন রাজশাহীতে। সেখানে প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার, রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট পোলিং অফিসারদের জেরা করবেন তারা।
কমিশন সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা কমিশনের বিভিন্ন প্রশ্নের খোলামেলা জবাব দিয়েছেন। এর আগে তিনি ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে যেসব কথা বলেছেন, কমিশনের কাছে প্রায় একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন। কমিশনের জেরার মুখে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হয়েছে বলে স্বীকার করেছেন। একই সঙ্গে ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়ে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, দলের নেতা-কর্মী, নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। একাদশ জাতীয় সংসদের ভোট হয়েছিল ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ওই নির্বাচনের পরপরই দিনের ভোট রাতে করার বিষয়টি দেশেবিদেশে ব্যাপক আলোচিত হয়। গত ২২ জুন সন্ধ্যার দিকে ঢাকা মহানগর উত্তরের স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা-কর্মীরা সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদাকে আটক করে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন। পরে উত্তরা-পশ্চিম থানা পুলিশ তাকে হেফাজতে নেয়।
২০১৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। প্রধান নির্বাচন কমিশনার করা হয় কে এম নূরুল হুদাকে। এই কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০২২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি এই কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়।
একইভাবে নির্বাচন তদন্ত কমিশনের জেরার মুখে পড়েন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক। তাকেও কারাগারে জেরা করা হয়। এ বি এম খায়রুল হক ২০১০ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০১১ সালের ১৭ মে পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ ২০১১ সালের ১০ মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন। তার মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অবৈধ হয়ে যায়। খায়রুল হক অবসরে যাওয়ার পর ২০১৩ সালের ২৩ জুলাই তাকে তিন বছরের জন্য আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ওই মেয়াদ শেষে কয়েক দফা পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয় তাকে। জুলাই গণ অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ১৩ আগস্ট আইন কমিশন থেকে পদত্যাগ করেন খায়রুল হক। বাংলাদেশের যে কোনো স্থান পরিদর্শন, যে কোনো দপ্তরের দলিল দস্তাবেজ তলব এবং সন্দিগ্ধ যে কোনো ব্যক্তিকে কমিশনে তলব ও জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বিগত তিন নির্বাচনের অভিযোগ তদন্তে গঠিত কমিশনকে। পাশাপাশি নির্বাচন কার্যক্রমে আইন প্রয়োগকারী ও গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে পারবে তারা। এমন ক্ষমতা নিয়েই কাজ করছে ওই কমিশন।
পাঁচ সদস্যের কমিশনের সভাপতি করা হয়েছে হাই কোর্টের সাবেক বিচারপতি শামীম হাসনাইনকে। কমিটির সদস্য হিসেবে আছেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব শামীম আল মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক, আইনজীবী তাজরিয়ান আকরাম হোসাইন এবং নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মো. আবদুল আলীম।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে প্রথমে কমিটি গঠনের ঘোষণা দেওয়া হলেও পরে কমিশন গঠন করা হয়। ২৯ জুলাই এ নিয়ে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। কমিশনকে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের ২ নম্বর ব্লকে অফিস সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে জারি করা গেজেটে বলা হয়েছে-২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই তিনটি নির্বাচন নিয়ে দেশেবিদেশে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। এসব নির্বাচনে নানা কৌশলে জনগণের ভোট দেওয়ার অধিকার ভূলুণ্ঠিত করে সাজানো প্রক্রিয়ায় একটি বিশেষ দলকে নির্বাচিত করার জোরালো অভিযোগ রয়েছে।