১৪ বছর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন। গত বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে আবারও ফিরে এসেছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানের পর সেই রায়ের বিরুদ্ধে একাধিক আপিল করা হয়। সেসব আপিল মঞ্জুর ও পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ গত বৃহস্পতিবার এই রায় দেন। এই রায়ের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে ফিরে এলো। তবে এই রায়টি এখনই কার্যকর হবে না। এটি কার্যকর হবে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে।
১৯৯৪ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তৎকালীন বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে নামে। ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী আনে বিএনপি সরকার। এরপর এই পদ্ধতির অধীনে ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম এবং ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। ২০০৪ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অগণতান্ত্রিক ও সংবিধানবহির্ভূত আখ্যা দিয়ে আইনজীবী এম সলিমউল্যাহসহ তিন আইনজীবী হাই কোর্টে একটি রিট করেন। শুনানির পর তিন বিচারপতির বৃহত্তর বেঞ্চ ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রায় দেন। রায়ে বলা হয়, ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত ও বৈধ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোট। ওই বছর রিট আবেদনকারীরা হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন।
২০১০ সালে আপিলে শুনানি শুরু হয়। সর্বোচ্চ আদালত এই মামলায় অ্যামিকাস কিউরি (আদালতকে সহায়তাকারী) হিসেবে দেশের আটজন সংবিধান বিশেষজ্ঞের বক্তব্য শোনেন। তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। এমনকি সে সময়ের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পক্ষে মত দেন। প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকসহ আপিল বিভাগে তখন সাতজন বিচারপতি ছিলেন। ছয় বিচারপতির তিনজনই অ্যামিকাস কিউরিদের পক্ষে একমত হন। এমন পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতি হিসেবে এ বি এম খায়রুল হকের হাতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ছিল। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে ২০১১ সালের ১০ মে রায় ঘোষণা করেন। সেই রায়টি ‘ত্রুটিপূর্ণ’ উল্লেখ করে গত বৃহস্পতিবার তা বাতিল করে দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। আইনজীবী, রাজনীতিবিদসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা ফেরানোর রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা মনে করেন, এর ফলে নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের কারচুপি করার সুযোগ বন্ধ হবে।
এদিকে দেশে নির্বাচিত সরকার না থাকায় আমরা আজ এক অস্বস্তিকর বাস্তবতার মুখোমুখি। খুন, অপহরণ, সংঘাত, সংঘর্ষ, ডাকাতি, ছিনতাই লেগেই আছে। গত ১৪ মাসে রাজধানীতে ৪৫৬টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রতি মাসে গড়ে ৩০টির বেশি খুনের ঘটনা যে কোনো সভ্য শহরের জন্য আইনশৃঙ্খলার মারাত্মক অবনতির সংকেত। এর চেয়েও ভয়াবহ হলো হত্যাকান্ডের ধরনে পরিবর্তন। নিষ্ঠুরতার চরম বহিঃপ্রকাশ। লাশ পাওয়া যায় টুকরা ও বিকৃত অবস্থায়।
নদী-ড্রেন থেকে অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। খুনের পর দ্রুত যাতে শনাক্ত না করা যায়, সেজন্য পরিকল্পিতভাবেই নানা নিষ্ঠুর পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। এসবই বোঝায় অপরাধ এখন কতটা সংগঠিত এবং কতটা নির্মম। ধারণা করা হয়, রাজনৈতিক সংঘাত, আধিপত্য বিস্তার, পারিবারিক বিরোধ, প্রেমঘটিত টানাপোড়েন ও আর্থিক রেষারেষি খুনের প্রধান কারণ।
দেশের অর্থনীতি অত্যন্ত ভঙ্গুর ও নাজুক হয়ে পড়েছে। পতিত স্বৈরাচার পালিয়ে যাওয়ার আগে দেশকে দেউলিয়াত্বের দ্বারপ্রান্তে রেখে গেছে। বর্তমান সরকার অর্থনীতির চূড়ান্ত পতন ঠেকাতে সক্ষম হলেও প্রত্যাশিত বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। মূলত জাতীয় নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা ছাড়া এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব নয়।
নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক সমঝোতা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা ছাড়া কেউ এখানে বিনিয়োগ করতে আসবে না। এমনকি আইএমএফের ঋণচুক্তির কিস্তি ছাড়ের ক্ষেত্রেও নির্বাচনকে একটি পরোক্ষ শর্ত হিসেবে হাজির করেছে। তবে যেনতেনভাবে একটি জাতীয় নির্বাচন কারোই কাম্য নয়। নির্বাচন হতে হবে রাজনৈতিক সমঝোতা, জাতীয় ঐকমত্য ও জুলাই সনদের ভিত্তিতে।
♦ লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য