নদীর ঘাটে ছিল নৌকার মাঝিদের হাঁকডাক। সড়কে ছিল পর্যটকের গাড়ির সারি। গাড়ি থেকে নেমে নৌকায় চড়ে পর্যটকরা ছুটতেন জল-পাথরের অপরূপ সৌন্দর্যের বিছনাকান্দিতে। জাফলংয়ের পরই সিলেটে বেড়াতে আসা পর্যটকদের দ্বিতীয় গন্তব্য ছিল সীমান্তঘেঁষা এই পর্যটন কেন্দ্র। কিন্তু বেহাল সড়ক যোগাযোগ ও পাথর লুটের কারণে ‘অপমৃত্যু’ ঘটেছে সম্ভাবনাময় বিছনাকান্দির। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঘেরা বিছনাকান্দি এখন কেবল বিরানভূমি। ভুলেও কেউ পা বাড়াতে চান না সেখানে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে স্থানীয়দের জীবন-জীবিকায়।
সিলেটের সীমান্তবর্তী গোয়াইনঘাট উপজেলায় অবস্থান বিছনাকান্দির। নদীর বুকে বিছানো পাথরের ওপর দিয়ে কলকল ধ্বনিতে বয়ে চলে পিয়াইনের স্বচ্ছ জলধারা। সীমান্তের ওপারে সারি সারি পাহাড় জল-পাথরের সৌন্দর্যকে দিয়েছে আলাদা মাধুর্যতা। সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে একসময় সিলেটে বেড়াতে আসা পর্যটকরা ছুটতেন বিছনাকান্দিতে। সিলেট শহর থেকে গোয়াইনঘাটের হাদারপাড় কিংবা পীরেরবাজার গিয়ে নৌকায় উঠতেন। নৌকায় করে সহজেই পৌঁছে যেতেন বিছনাকান্দিতে। কিন্তু গেল পাঁচ-সাত বছর ধরে সিলেট-সালুটিকর-হাদারপাড় সড়ক বেহাল। কোথাও খানাখন্দ ও কোথাও তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। আনফরেরভাঙা নামক স্থানে কালভার্টটির কাজও চলছে কয়েক বছর ধরে। ফলে গাড়ি চালকরাও ঝুঁকি নিতে চান না ওই সড়কে। যোগাযোগ ভোগান্তির কারণে পর্যটকরাও বেড়ানোর তালিকা থেকে বাদ দেন পর্যটন কেন্দ্রটি। এ ছাড়া গেল কয়েক বছর ধরে অবাধে পাথর লুটের কারণে সৌন্দর্য হারিয়েছে বিছনাকান্দি। আগে যেখানে নদীর বুকজুড়ে ছিল স্তরে স্তরে সাজানো পাথর; এখন মমূল পর্যটন স্পটে আছে কিছু পাথর। আর বাকি এলাকা মরুভূমিসম। কালেভদ্রে কোনো পর্যটক সেখানে গেলেও ফেরেন ক্ষোভ আর হতাশা সঙ্গী করে। পর্যটন কেন্দ্রটি ঘিরে একসময় হাজারো মানুষের জীবনজীবিকার ব্যবস্থা হতো। কেউ নৌকা চালাতেন, আবার কেউ পর্যটকদের আকৃষ্ট করে ব্যবসা করতেন হস্তশিল্পের। এ ছাড়া পর্যটন কেন্দ্রটি ঘিরে তৈরি হয়েছিল বেশ কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও। কিন্তু পর্যটন কেন্দ্রটির ‘অপমৃত্যু’ ঘটায় বেকার হয়ে পড়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিলেট থেকে বিছনাকান্দির দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে সিলেট থেকে সালুটিকর ১৬ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা মোটামুটি ভালো, আর বাকি ১৬ কিলোমিটার বেহাল। সালুটিকর থেকে তোয়াকুল পর্যন্ত সড়কে চলছে সংস্কার কাজ। আর আনফরেরভাঙা থেকে বিছনাকান্দি পর্যন্ত একেবারেই বেহাল। কোনো পর্যটক সাহস করে বিছনাকান্দি যেতে হলে আনফরেরভাঙা থেকে যেতে হয় ভাড়া করা মোটরসাইকেলে।
বিছনাকান্দি বেড়াতে আসা কুমিল্লার দেবিদ্বারের আবদুল কাইয়ূম জানান, প্রায় এক দশক আগে তিনি বিছনাকান্দি এসেছিলেন। বিছনাকান্দির সৌন্দর্যে তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। এবার বন্ধুদের নিয়ে অনেক ভোগান্তির পর এসে হতাশ তিনি। পাথরশূন্য বিছনাকান্দির আগের সৌন্দর্য নেই। পর্যটন কেন্দ্রজুড়ে কেবল শূন্যতা। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব সিলেট-টোয়াস সভাপতি হুমায়ূন কবীর লিটন বলেন, একসময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারো পর্যটক বিছনাকান্দিতে যেতেন। কিন্তু বেহাল সড়ক ও পাথর লুটের কারণে পর্যটকরা বিছনাকান্দিবিমুখ। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সাদাপাথরের মতো পর্যটন কেন্দ্রটি রক্ষার উদ্যোগ নিয়ে বিছনাকান্দি ফের প্রাণ ফিরে পেতে পারে।
স্থানীয় রুস্তুমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহাবুদ্দিন শিহাব জানান, আগে পর্যটন কেন্দ্রটি ঘিরে অনেক মানুষের জীবন-জীবিকা চালু ছিল। কিন্তু কয়েক বছর ধরে পর্যটকরা সেখানে না যাওয়ায় পর্যটন খাত-সংশ্লিষ্ট লোকজন অনেক কষ্টে আছেন। তারা বিকল্প পেশাও খুঁজে পাচ্ছেন না।