সময় যত যাচ্ছে, একটি নির্বাচিত সরকারের দাবি ততই জোরালো হচ্ছে। ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা মহল একটি রাজনৈতিক সরকারের অপেক্ষায়। চলমান পরিস্থিতিতে তারা চরম আস্থাহীনতায় এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়। ফলে নতুন উদ্যোগ-বিনিয়োগ কার্যক্রম প্রায় স্থবির।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) সাফ বলে দিয়েছে, নির্বাচিত সরকার না আসা পর্যন্ত তারা ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের পরবর্তী ষষ্ঠ কিস্তি ছাড় করবে না। অন্যদিকে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এক কণ্ঠে বলছেন, ‘নির্বাচিত সরকার ছাড়া নতুন বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ।’ ফলে অর্থনীতি এখন এক ধরনের ‘অপেক্ষার ঘূর্ণিতে’ পড়েছে। ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী ও উন্নয়ন সহযোগীরা সবাই রাজনৈতিক ম্যান্ডেট ও নীতিগত স্থিতিশীলতার প্রত্যাশায় আছেন।
অর্থনীতিবিদ ও উদ্যোক্তারা মনে করেন, নির্বাচিত সরকার না থাকায় আইএমএফের কিস্তি ঝুলে গেছে। বিনিয়োগকারীরা অপেক্ষায় আর অর্থনীতিও স্থবির। আস্থা ফিরলেই ঘুরে দাঁড়াবে পুঁজি, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধি— এমনটাই তাদের অভিমত। বলেন, ‘অর্থনীতি দাঁড়িয়ে থাকে রাজনৈতিক আস্থার ওপর। সেই আস্থা পুনর্গঠনের দায়িত্ব সরকারেরই।’
আইএমএফের শর্তে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অগ্রাধিকার : ২০২২ সালে আইএমএফের সঙ্গে ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করে বাংলাদেশ। এর মধ্যে পাঁচ কিস্তি ছাড় হলেও ষষ্ঠ কিস্তি এখন ঝুলে আছে। সংস্থাটি জানিয়েছে, নতুন সরকার গঠনের পরই তারা বাকি অর্থছাড়ের সিদ্ধান্ত নেবে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এটি রাজনৈতিক আস্থা ও নীতির ধারাবাহিকতার প্রশ্ন।
আবাসন খাতের শীর্ষ সংগঠন রিহ্যাবের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূইয়া বলেন, ‘ম্যানুফ্যাকচারিং, রিয়েল এস্টেট, ব্যাংকিং ও সেবা খাতে নতুন বিনিয়োগ এখন প্রায় বন্ধ। আইএমএফ অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক আস্থার সংকট দেখছে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া দায়বদ্ধতা ও নীতির ধারাবাহিকতা অনিশ্চিত। দেশি ব্যবসায়ীরাও বলছেন, এখন ঝুঁকি নেওয়ার সময় নয়।’
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক ইসহাকুল হোসাইন বলেন, ‘নির্বাচিত সরকার ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ নেওয়া আত্মহত্যার মতো ঝুঁকি। আমরা শুধু পুরনো কার্যক্রম চালাচ্ছি।’ তিনি বলেন, বিদেশি ক্রেতারা রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। রপ্তানি অর্ডারও কমছে। নির্বাচিত সরকার না এলে আস্থা ফিরবে না। রপ্তানি বাজারে স্থিতিশীলতা দরকার।’
সাময়িক সরকারের ওপর আস্থা কম উল্লেখ করে তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ইনামুল হক খান বলেন, ‘সাময়িক সরকারের ওপর কিছুটা আস্থা কম থাকে। ফলে আইএমএফ আগামী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চায়। ফলে সময়মতো নির্বাচন করার বিষয়ে চাপ তৈরি করবে। সবাই নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চায়। তখন আস্থা ও বিনিয়োগ বাড়বে। এখন ছোট-বড় সব বিনিয়োগ বন্ধ।’
বিদেশি বিনিয়োগ থমকে, পুঁজি পাচারের আশঙ্কা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ২২ শতাংশ কমেছে। নতুন প্রকল্প নিবন্ধনেও গতি নেই। বিডা কর্মকর্তারা জানান, বেশির ভাগ বিদেশি বিনিয়োগকারী এখন ‘অপেক্ষা-পর্বে’ আছেন। অনেকে নতুন কারখানা না করে পুরনো ব্যবসা সংকুচিত করছেন। কেউ কেউ বিদেশে সম্পদ স্থানান্তর করছেন, যা অর্থনীতির জন্য বিপজ্জনক ইঙ্গিত।
সরকারের প্রস্তুতির ঘাটতি, আস্থার সংকট
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই স্থবিরতা কেবল রাজনৈতিক নয়; সরকারের প্রস্তুতি ও নীতি পরিচালনায় স্বচ্ছতার অভাবও দায়ী। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি বলেন, ‘সরকার যদি অর্থনৈতিক নীতিতে পূর্বানুমানযোগ্যতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখত, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রভাব এত গভীর হতো না।’
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অবশ্য দাবি করেছেন, আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে এবং নতুন সরকার গঠনের পর ঋণচুক্তি দ্রুত সচল হবে।
বিনিয়োগ স্থবিরতার প্রভাব স্পষ্ট
বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় ব্যাংক খাতে ঋণ চাহিদা কমেছে, নির্মাণসামগ্রী, ইলেকট্রনিকস ও রিয়েল এস্টেট খাতে নতুন প্রকল্প স্থগিত রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের হিসাবে, এ কারণে অন্তত ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক কর্মসংস্থান হারানোর ঝুঁকিতে আছেন। শিল্পোদ্যোক্তা বলেন, বাজারে চাহিদা নেই, বিনিয়োগে আগ্রহ নেই। অর্থনীতি এখন নিশ্বাস নিচ্ছে, কিন্তু হাঁটতে পারছে না।
নির্বাচিত সরকার ছাড়া বিনিয়োগের অনাগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) প্রেসিডেন্ট আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, ‘দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে এখন সবচেয়ে জরুরি নির্বাচন নিয়ে স্পষ্টতা ও আস্থা ফেরানো। সরকারকে দ্রুত জানাতে হবে ঠিক কবে নির্বাচন হবে এবং সেটি যেন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, জ্বালানি খাতের স্থিতিশীলতা, সরকার, ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক পুনর্গঠিত না হলে বিনিয়োগ সচল করা সম্ভব নয়।’
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু এখন সেটা অনিশ্চিত। জাতীয় নির্বাচন কবে হবে, কেউ বলছে ফেব্রুয়ারিতে আবার কেউ বলছে নাও হতে পারে। এই অনিশ্চয়তার কারণে বিনিয়োগকারীরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
তার ওপর ব্যবসার খরচ বাড়ছে, জ্বালানি নিরাপত্তা দুর্বল, আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হয়নি। ফলে ব্যাবসায়িক পরিবেশটা অস্থির। যতক্ষণ না রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল সরকার আসে, ততক্ষণ বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিতে চাইবেন না।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরলেই অর্থনীতিতে প্রাণ ফিরে আসবে উল্লেখ করে এই ব্যবসায়ী নেতা আরও বলেন, নির্বাচিত সরকার গঠনের পর আইএমএফের ঋণচুক্তি পুনরায় সচল হবে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে। তাঁর মতে, এখন সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে আস্থা পুনর্গঠন, অর্থনৈতিক নীতিতে স্বচ্ছতা, বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি এবং আইনের শাসন ও পূর্বানুমানযোগ্য প্রশাসনিক কাঠামো নিশ্চিত করা।
এদিকে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি) বলছে, দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি এখন বেশ দুর্বল। ২০২৫ সালের আগস্টে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬.৩৫ শতাংশ, যা ইতিহাসের অন্যতম সর্বনিম্ন হার। ব্যবসায়ীরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন, কারণ সুদের হার বেশি, ব্যাংকগুলো সতর্কভাবে ঋণ দিচ্ছে আর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়েছে। অন্যদিকে সরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে ১৬.৫৯ শতাংশ। কারণ সরকার বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিচ্ছে। এতে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থের জোগান কমে যাচ্ছে। ফলে শিল্প ও ব্যবসা সম্প্রসারণ শ্লথ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর নীতি মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমালেও তা বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও আর্থিক খাতে কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারেনি। ব্যাংক খাতে সুদের হার এখনো ১৩ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে আর সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও রয়ে গেছে নাজুক অবস্থায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি আরো জটিল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ায় মূল্যস্ফীতি আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। এই অস্থির পরিবেশে বিনিয়োগের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম, ফলে বিনিয়োগকারীরাও স্বাভাবিকভাবেই নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী নন। বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ও বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে এখন একটি নির্বাচিত, পূর্ণাঙ্গ সরকারের বিকল্প নেই।’
এ বিষয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় অর্থনীতির অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক রিজার্ভ, বিনিময় হার ও ব্যাংক খাতে ছিল অস্থিরতা। তবে সরকার দ্রুত কিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে, যেমন—ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, দুর্বল ব্যাংক একীভূতকরণ এবং রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে রিজার্ভ বেড়েছে, বিনিময় হারেও এসেছে স্থিতি। তিন বছর ধরে চলা উচ্চ মূল্যস্ফীতি ধীরে ধীরে কমছে। সব মিলিয়ে অর্থনীতি এখন পুনরুদ্ধারের পথে থাকলেও টেকসই স্থিতিশীলতার জন্য আরো কার্যকর নীতি দরকার।
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ