ভোট সামনে রেখে চলছে জোটের কড়া হিসাব। কোন দল কার সঙ্গে জোট করবে, কে কাকে কত আসন ছাড়বে না ছাড়বে- জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলো এখন চরম ব্যস্ত নির্বাচনি জোট ও আসন সমঝোতার হিসাবনিকাশে। পর্দার আড়ালে এ নিয়ে চলছে অবিরাম আলাপ-আলোচনা, যোগ-বিয়োগের সমীকরণ। রাজনৈতিক দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতারা এলাকায় প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি শীর্ষ নেতাদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন অহরহ। বিএনপি ব্যস্ত জোট বাড়ানোর প্রক্রিয়ায়। বেশ কিছু দল বিএনপির সঙ্গে জোট গঠন করতে দলটির শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ রাখছে। তবে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য দলকেই জোটে নেবে বিএনপি। কোনো জনবিচ্ছিন্ন দলকে জোটে নিয়ে তারা বোঝা বাড়াবে না বলে জানা গেছে। অন্যদিকে প্রতিপক্ষ জামায়াতে ইসলামীও বসে নেই। দলীয় মোর্চা বাড়াতে রাতদিন কাজ করছেন দলটির নেতারা।
জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াতের বাইরেও নির্বাচনি জোট ও কৌশল নির্ধারণে প্রতিদিনই হচ্ছে অগণিত বৈঠক, মিটিং, গোপন সমঝোতা ও বার্তালাপ। নির্বাচন সামনে রেখে এবার বৃহৎ জোট গঠনের দিকে বিএনপি। বিএনপির প্রতিও দিনদিন রাজনৈতিক দলগুলোর ভরসা ও আস্থা বাড়ছে। যুগপৎ আন্দোলনের শরিক ও সমমনা দল ছাড়াও এর বাইরে ফ্যাসিবাদবিরোধী আরও কিছু দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে। তাদের সবাইকেই নির্বাচনি জোটের অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। অন্যদিকে জুলাই গণ অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণতন্ত্র মঞ্চ ও সিপিবির নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোটও নির্বাচন সামনে রেখে নয়া মেরুকরণ করতে চায়। অবশ্য এদেরসহ আরও বিভিন্ন দল নিয়ে একটি বড় আকারের নির্বাচনি জোট গঠন করতে চায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি।
নির্বাচনি জোটের বিষয়ে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী সালাহউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির নেতৃত্বে একটি বৃহৎ জোট গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। এতে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোট ছাড়াও যুগপৎ-এর বাইরে হাসিনা সরকারবিরোধী মনোভাবাপন্ন দলগুলোর সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী ও গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনি জোটে আসতে চাইবে তাদের সবাইকেই এর অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা চাইব বিএনপির সঙ্গে বোঝাপড়া করার জন্য। গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে অন্য এক আলাপ-আলোচনা চলছে। সবার সঙ্গেই আমরা কথাবার্তা বলব।’
বিশ্লেষকদের মতে, এবারের নির্বাচনে জোটই হবে ইতিবাচক ফল নির্ধারণের বড় উপাদান। কারণ দেশের অনেক নির্বাচনি এলাকায় ভোটের ব্যবধান খুবই কম। ফলে কয়েকটি ছোট দলের ভোটই ভারসাম্য বদলে দিতে পারে সেসব ক্ষেত্রে। সব মিলে আসন্ন ভোটে জোটের সমীকরণই এখন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। কারা কার সঙ্গে যাবে, কত আসনে ছাড় দেবে, আর শেষ পর্যন্ত কে কাকে ভরসা করবে- সেই হিসাবই এখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।
জানা গেছে, যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ছিল এমন সমমনা দল-জোটসহ অন্যান্য উদার গণতান্ত্রিক, ইসলামি ও আলেমদের সমন্বয়ে জোট গঠন করা হবে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসসহ ধর্মীয় দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির মিত্র দল ও জোট যথাক্রমে ছয় দলের সমন্বয়ে গঠিত গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২-দলীয় জোট, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, গণফোরাম, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (বিপিপি), লেবার পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদ। যুগপৎ-এর শরিক দলগুলোর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছে বিএনপি। ধারণা পাওয়া গেছে, দলটির নেতৃত্বে যে বৃহৎ নির্বাচনি মোর্চা হতে যাচ্ছে, সেখানে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য, গণফোরাম ও লেবার পার্টি থাকছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী এরই মধ্যে নিজেদের মতো করে একটি নতুন ইসলামি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে আরও আগে থেকেই। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (চরমোনাই পীরের দল), খেলাফত মজলিস এবং হেফাজতে ইসলামের একাংশকে সঙ্গে নিয়ে আলাদা একটি ইসলামি জোট গঠনের আলোচনায় রয়েছে জামায়াত। যদিও মামুনুল হকের নেতৃত্বাধীন হেফাজতের অংশ এই প্রক্রিয়ায় না থেকে শেষ পর্যন্ত বিএনপি জোটের দিকেই ঝুঁকতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
নির্বাচন সামনে রেখে জুলাই গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে জোট হতে পারে বলে জানিয়েছেন এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু। তিনি বলেন, ‘নতুন দলগুলো নিয়ে জোট গড়ার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা এগিয়েছে। এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে আমরা আশা করছি, শিগগিরই বিষয়টি পরিষ্কারভাবে প্রকাশিত হবে।’
লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান জানান, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি যে জোট করতে যাচ্ছে, তার সঙ্গে তাঁর দল রয়েছে। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমরা যুগপৎ আন্দোলনে ছিলাম। সামনে নির্বাচন। কোনো জোট নয়, তাদের সঙ্গে আমাদের আসন সমঝোতার আলোচনা অব্যাহত আছে।’ বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ জানান, তাঁর দল বিএনপি জোটের সঙ্গে আছে।
এদিকে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না হলেও এরই মধ্যে জোটকেন্দ্রিক ভোট করার ব্যাপক আগ্রহ দেখা যাচ্ছে বড় দলগুলোর মাঝে। বিশেষ করে গণ অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রদের নবগঠিত তারুণ্যভিত্তিক রাজনৈতিক দল এনসিপির সঙ্গে বিএনপি অথবা জামায়াতের নির্বাচনি জোট বা কোনো আসন সমঝোতা হয় কি না, এ নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে। এ নিয়ে দল দুটির সঙ্গে এনসিপির অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও চলছে বলে জানা গেছে। শেষ পর্যন্ত বিএনপি নাকি জামায়াত- কোন দলের সঙ্গে যাবে এনসিপি, সেই আলোচনাও চলছে দলের মধ্যে। দুইটি জোটের সঙ্গে নির্বাচনি জোট বা সমঝোতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে লাভক্ষতির হিসাব কষছে দলটি।
এ বিষয়ে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘জামায়াতসহ একাধিক রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমরা কারও সঙ্গে জোটে যাচ্ছি নাকি বা এককভাবে নির্বাচন করব- সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এখনো হয়নি। আমরা পরিস্থিতি বিবেচনা করছি।’
জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি এহসানুল মাহবুব জোবায়ের বলেন, ‘আমার ধারণা আরেকটু সময় গেলে স্পষ্ট হবে কে কোন জোটে বা কার সঙ্গে সমঝোতায় যাবে। এনসিপির সঙ্গে সমঝোতা বা জোট গঠনের সুযোগ তো আছেই। আলোচনা ও মতবিনিময় চলছে।’ নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, যুগপৎ-এর শরিক দলগুলোর সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেছে বিএনপি। দলটির নেতৃত্বে যে বৃহৎ নির্বাচনি মোর্চা হতে যাচ্ছে, সেখানে এলডিপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, বাম গণতান্ত্রিক ঐক্য, গণফোরাম ও লেবার পার্টি থাকছে।
এ বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জোট গঠনের আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে মাত্র। দেখা যাক সেটি কীভাবে গঠিত হয়। তবে আমরা বিএনপির সঙ্গে শুরু থেকেই আছি।’
১২-দলীয় জোটের প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দার এ বিষয়ে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আমরা যুগপৎ আন্দোলনে ছিলাম। আগামী নির্বাচনেও একসঙ্গে অংশগ্রহণ করব।’ গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিএনপির নেতৃত্বে যে নির্বাচনি জোট হতে যাচ্ছে, তাতে আমরা আছি। এরই মধ্যে আমরা সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকাও জমা দিয়েছি তাদের কাছে।’
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের প্রধান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে আমাদের জোট ছিল। ভবিষ্যতেও যে কোনো মেরূকরণে বিএনপির সঙ্গে থাকব।’ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান জানান, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি যে জোট করতে যাচ্ছে, তার সঙ্গে তার দল রয়েছে।
অন্যদিকে দেশের আলেম সমাজ ও তাদের গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে পাশে চায় বিএনপি। এজন্য দলটির নেতারা এরই মধ্যে হাটহাজারী মাদরাসা, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির, ছারছীনা পীর, আলিয়া মাদরাসা-ধারার যেসব মুরুব্বি ও আলেম আছেন, তাঁদের সঙ্গেও দেখা করেছেন।