ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের এক বছরের বেশি সময় পরও শৃঙ্খলা ফেরেনি প্রশাসনে। উপরন্তু বিশৃঙ্খলা আরও বেড়েছে। অনেকে সিনিয়রদের নির্দেশনা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইচ্ছামতো দায়িত্ব পালন করছেন। বদলি করা হলেও আদেশ না মেনে আগের কর্মস্থলে থাকতে চাচ্ছেন। পদায়ন হলে যোগদান ঠেকানো হচ্ছে। এমন বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে আসতে মেরামতের উদ্যোগ নিচ্ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ভেঙে পড়া চেইন অব কমান্ড ফেরানোসহ রদবদলে শৃঙ্খলা আনতে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নতুন সিনিয়র সচিব হিসেবে মো. এহছানুল হক যোগ দিয়ে কর্মকর্তাদের নানান নির্দেশনা দিয়েছেন। এদিকে একজন অতিরিক্ত সচিবের সমমান পদায়ন, নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগের (এপিডি) নিয়োগ গড়িয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কাছে। বিষয়টি নিয়েও প্রশাসনে নানা আলোচনা চলছে। মন্ত্রণালয়-সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। প্রশাসনের শীর্ষপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অদক্ষতা ও দলবাজির কারণে জনপ্রশাসনে বিশৃঙ্খলা কাটেনি বলছেন প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা। তবে নতুন সচিব দ্রুত উদ্যোগ নেবেন এমন প্রত্যাশা করেছেন অনেকে।
সূত্র জানায়, গত ১২ অক্টোবর জনপ্রশাসনে নতুন যোগ দিয়ে বিকালে মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ও তদুর্ধ্ব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠকে কর্মকর্তাদের কথা শুনে একগুচ্ছ নির্দেশনা দেন। সততা বজায় রেখে কাজ করা, আসন্ন নির্বাচনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখাসহ রদবদলের ক্ষেত্রে সবসময় যোগ্যতার বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে বলা হয়েছে। এর পরও কয়েক দফায় বিভিন্ন উইংয়ের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা মনে করছেন, প্রশাসন মেরামতের কাজ অনেকটাই শুরু হয়েছে। দ্রুতই রদবদলের ক্ষেত্রেও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। যারা শীর্ষস্থানে বসে আছেন তাদের অদক্ষতা এবং অপেশাদার দলবাজি একটা বড় কারণ। তবে বর্তমানে জনপ্রশাসনে আসা সচিব যদি অন্য কোনো দিক থেকে বাধা না পায় এবং ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারেন তবে উন্নতি হবে ভেঙে পড়া প্রশাসনের।
সূত্র জানায়, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর প্রশাসনে চর দখলের মতো চেয়ার দখলের প্রতিযোগিতায় নামেন কিছু আমলা। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, যেন স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে এখন প্রশাসনে একেবারেই কোনো কমান্ড নেই। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরের সচিব নিয়োগে বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। একজনকে ডিঙিয়ে আরেকজন দখল করতে মরিয়া। আর তারই অংশ হিসেবে জনপ্রশাসনের এপিডি নিয়োগ গড়িয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে। অথচ এ দায়িত্ব কে পাবে সেটি সচিব নির্ধারণ করে দেন।
প্রায় দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে খালি পড়ে থাকার পর গতকাল জনপ্রশাসন একটি অভ্যন্তরীণ আদেশ দিয়েছে। এপিডি ছাড়াই সরাসরি শাখার যুগ্মসচিবরা সচিবের কাছে ফাইল পাঠাবেন। সূত্র জানায়, এপিডি পদে দুটি রাজনৈতিক দলের ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সরকারের এক প্রভাবশালী উপদেষ্টার অনুগত কর্মকর্তাকে বসানোর জোর তৎপরতা চলছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে সদ্য নিয়োগ পাওয়া খুলনার কমিশনারকে এ পদে নিয়োগের জন্য আনা হলেও তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। মূলত মন্ত্রণালয়ের এপিডি থেকেই সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব ও উপসচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি, পদোন্নতি ও প্রেষণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের জন্য ফাইল পাঠানো হয়। সূত্র জানায়, এই পদের বিষয়টি উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে নির্দেশনা এলে দায়িত্ব দেওয়া হবে।
প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানান, একটি অতিরিক্ত সচিবের সমমানের পদে নিয়োগ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা পর্যন্ত গড়ানোর বিষয়টি শোভন নয়। রাষ্ট্রের নির্বাহী প্রধান হিসেবে তাঁকে অনেক বড় বড় বিষয়গুলো দেখতে হয়। সূত্রটি জানায়, সরকারের একটি পক্ষের ইচ্ছাতে সম্প্রতি খুলনা বিভাগীয় কমিশনার ও অতিরিক্ত সচিব ফিরোজ সরকারকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এপিডির জন্য আনা হয়। অথচ প্রভাবশালী একটি মহল তাকে এপিডিতে পদায়ন করতে দেয়নি। তাকে অন্য উইংয়ে দেওয়া হয়েছে। এই নিয়োগ না দেওয়ার পেছনে একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ রয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে বিশৃঙ্খলতার কারণে অনেকের আদেশ হচ্ছে আবার বাতিল হচ্ছে। কোনো কমান্ড নেই। আবার বদলির আদেশ হলেও কর্মকর্তারা যোগ দিতে গিয়ে বাধা পাচ্ছেন। মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার পছন্দ না হলে সচিবের যোগদানও আটকে যাচ্ছে। এতে প্রশ্ন উঠেছে, প্রধান উপদেষ্টা সচিব নিয়োগ দেওয়ার পর উপদেষ্টা আটকে দেয় কীভাবে? এতে কার ক্ষমতা বেশি সেটি নিয়েও প্রশাসনে নানামুখী আলোচনা চলছে।
সূত্রটি জানায়, গত ৩ আগস্ট পদোন্নতি দিয়ে অতিরিক্ত সচিব এস এম শাকিল আখতারকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়। বিসিএস ১৫তম ব্যাচের এই কর্মকর্তা ই-মেইলে যোগদানপত্র দিলেও উপদেষ্টার আপত্তির কারণে সচিবের চেয়ারে বসতে পারেননি। মার্চ থেকে সচিব নেই পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগে। আগস্টে স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. সারোয়ার বারী অবসরে গেলেও অদ্যাবধি এ বিভাগে সচিব নেই। বর্তমানে সব মিলিয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগ, পরিকল্পনা বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে সচিব নেই। এসব গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের রুটিন দায়িত্ব পালন করছেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা। নিয়মিত সচিব না থাকায় এসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দাপ্তরিক কাজকর্ম ব্যাহত হচ্ছে। তবে এসব পদ দ্রুতই পূরণ হবে বলে জানিয়েছে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তারা।