আবুল কালাম আজাদ যখন দেখলেন, ‘তারকালোক’ ম্যাগাজিনের একটি সংখ্যার প্রচ্ছদে পীযূষ-আফরোজার ছবি, তিনি সেখান থেকেই বানালেন পোস্টার। সেই টিভি নাটকটি এতই জনপ্রিয় ছিল, প্রচুর মানুষ সেসব পোস্টার ও পিনআপ কিনতে শুরু করে। এরপর সাড়া জাগায় জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী জুটি আফজাল হোসেন-সুবর্ণা মুস্তাফার ছবিসংবলিত ভিউকার্ড। এতে আজাদের ব্যবসারও প্রসার ঘটতে থাকে। এরপর থেকে প্রসারটা বিরাট আকারে বেড়ে যায়। ৫ হাজার কার্ড দিলে তারা দুই দিন পরে এসে বলে ১০ হাজার দেন। এতই জনপ্রিয়তা ছিল এই কার্ডের। এই জনপ্রিয়তা দীর্ঘসময় ছিল...
বিশেষ দিনে বিশেষ মানুষকে শুভেচ্ছা কার্ড জানানোর রীতি ছিল আমাদের। এই কার্ড না দিলে বোধ হয় আমাদের ভালোবাসা, শুভেচ্ছাগুলো পরিপূর্ণ হতো না, আর তার জন্য বিখ্যাত ছিল আজাদ প্রোডাক্টস। আশির দশক থেকে গত দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত আজাদ প্রোডাক্টস ছিল চাহিদার শীর্ষে। শুভেচ্ছা কার্ড মানেই যেন আজাদ প্রোডাক্টস। শুধু তাই নয়, জনপ্রিয় তারকাদের ভিউকার্ড ছিল আজাদ প্রোডাক্টসের অন্যতম জনপ্রিয়তার কারণ। সালমান শাহর অকাল মৃত্যুর পর শুধু তার ভিউকার্ড দিয়েই আজাদ প্রোডাক্টস ব্যবসায়িকভাবে প্রচুর লাভ করেছিলেন। এই আজাদ প্রোডাক্টসের যিনি মালিক, তিনি এ দেশের উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা, শূন্য থেকে শুরু করে যিনি হয়েছেন সফলতম ব্যবসায়ী, তিনি আবুল কালাম আজাদ। একটা সময় ছিল যখন উৎসব-জন্মদিন কিংবা ভালোবাসা প্রকাশের জন্য কার্ডই ছিল ভরসা। পছন্দের তারকার পোস্টার আর ভিউকার্ড জমানো ছিল অন্যতম শখ। এ দেশে এই ভালোলাগার সুযোগটা যিনি প্রথম করে দিয়েছিলেন তিনি আজাদ প্রোডাক্টসের কর্ণধার আবুল কালাম আজাদ। বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে শিক্ষক হবে। কিন্তু আবুল কালাম আজাদ
ছিলেন পুরদস্তুর ব্যবসায়ী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। তাই নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে ছেলেবেলাতেই ১৯৭৩ সালে শরীয়তপুর থেকে পালিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। হকার হিসেবে পোস্টার বিক্রির মাধ্যমে শুরু করেন ব্যবসা। তবে বন্ধ রাখেননি পড়াশোনা। বসতেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের গেটের সামনে। এখান থেকে ধীরে ধীরে সৃষ্টি হয় আজাদ প্রোডাক্টসের। অল্প বয়স থেকেই তাঁর ব্যবসার প্রতি ছিল আগ্রহ। বাবার অমতে ১৮ টাকা পুঁজি নিয়ে এলাকায় নারিকেলের ব্যবসা শুরু করেন। সাত বছর বয়সে তার মা সালেহা বেগম মারা যান। তার বাবা ছিলেন একজন স্কুলশিক্ষক। নিজের জীবনের উত্থান-পতনের মধ্যে ব্যবসায় চিন্তার প্রসার বাড়াতে থাকেন। দেশে মোবাইল ফোন ও কম্পিউটার আসার আগে ডায়েরি, পিনআপ, পোস্টার, ভিউকার্ডের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। অল্প দিনেই তাঁর এই ব্যবসা এগিয়ে যায়। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে প্রযুক্তির ছোঁয়ায় তার এই প্রিন্টিং শিল্প অনেকটা ধস নেমেছে। ক্ষতির মুখে পড়েছে প্রিন্টিং শিল্প। ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে মুহূর্তেই প্রিয়জনকে মেসেজ পাঠানো যাচ্ছে। ফেসবুক, টুইটারে মনের ভাব প্রকাশ করছে। এ অবস্থায় পারসোনাল কার্ড, ভিউকার্ড, পোস্টার ৯০ শতাংশ বিক্রি কমেছে। তবে এখনো সরকারি-বেসরকারি অফিশিয়াল কার্ড, বিয়ের কার্ডের কিছুটা চাহিদা রয়েছে। আজাদ প্রোডাক্টসের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদের কথায়, আমার জীবনটা মোটেই সহজ ছিল না। বাবা চেয়েছিলেন আমিও শিক্ষকতা করি। পরবর্তী সময় মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পর আমার ধারণা হলো বসে না থেকে কিছু একটা করা। এরপর বাবার সঙ্গে এলাকার হাটে গেলাম পাট নিয়ে। বাজারে গিয়ে এদিকসেদিক ঘুরে আমার মনে হলো সবকিছুর দাম সম্পর্কে জানা। পরে দেখি শুকনা নারকেল বিক্রি করছে। এরপর তার দাম শুনলাম। তখন আমার ভাবনা হলো যদি হাট থেকে নারকেল কিনে বিক্রি করি তাহলে খারাপ কী। এরপর এক ভাইয়ের কাছে পরামর্শ নেই। পরে অল্প কিছু নারকেল এনে বিক্রি করা শুরু করি। এভাবেই ব্যবসার হাতেখড়ি। আমি হেরে যাইনি, স্বপ্ন যেটা দেখেছি তার চেয়ে বেশি পেয়েছি। আমার বাবা-মায়ের ছিলাম একমাত্র সন্তান। বাবা চেয়েছিলেন আমি পিটিআই পড়ি। সাত বছর বয়সে আমার মা মারা যান। পরবর্তী সময় বাবা বিয়ে করেন। এরপর উচ্চ মাধ্যমিক পাস করি। একসময় আমি বাড়িতে না বলে ঢাকায় চলে আসি। এরপর আমার পরিচিত এক হুজুর একটি লজিং ঠিক করে দেন। এভাবে ছয় মাসের মতো চলে যায়। পরে ঢাকার বোরহান উদ্দিন কলেজে ভর্তি হই। ওই বাসার লজিংটাও চলে যায়। আরেকটি লজিং ঠিক হয়। তখন মনে হলো আমি আমার জীবনের আরেকটি ধাপ এগিয়ে গিয়েছি। পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য চার-পাঁচটা টিউশনি করি। বাবা তো টাকা-পয়সা দেবেনই না, কারণ তাঁর ইচ্ছে ছিল আমি যেন পিটিআই পড়ি। একপর্যায়ে আমি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করি। ব্যবসায়িক জীবনের শুরু সম্পর্কে তিনি বলেন, ঢাকা শহরের আনাচকানাচে ঘুরে ঘুরে দেখলাম স্বল্পপুঁজিতে কীভাবে ব্যবসা করা যায়। নারকেলের ব্যবসা থেকে আমার মধ্যে ব্যবসার নেশাটা আরও বেশি চেপে ধরে। এর মধ্যে জীবনের অনেক উত্থান-পতন দেখেছি। কিছুদিন পরে এজিবি কলোনিতে স্বল্পমূল্যে একটি ছোট রুম নিয়ে থাকা শুরু করলাম। একদিন দেখি এক ব্যক্তি পোস্টার বিক্রি করছে। তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি পোস্টারের ব্যবসাটা ভালো। মনে মনে ভাবতে থাকি স্বল্পপুঁজিতে এই ব্যবসাটা করা যায়। এভাবেই ব্যবসায় আসা। সে সময় বাংলাদেশ টেলিভিশন সবেমাত্র বিদেশি অনুষ্ঠান প্রচার করা শুরু করেছে। ডালাস, বায়োনিক ওম্যান, ডাইন্যাস্টি ইত্যাদি সিরিজের চরিত্রগুলো মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল জানিয়ে আজাদের কথা হলো, তিনি কিংবদন্তি ফুটবলার ম্যারাডোনা, গানের দল বনি এম ও সুইডিশ পপ গ্রুপ অ্যাবার পিনআপ আমদানি করতেন। তিন মাসের মধ্যেই আজাদের পুঁজি দাঁড়িয়েছিল ৭০ হাজার টাকায়। আজাদ সে সময় বিভিন্ন জনপ্রিয় তারকার পোস্টার আমদানি ও বিক্রির ক্ষেত্রে এক নতুন মাইলফলক সৃষ্টি করেছিলেন দেশে। আশির দশকে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও আফরোজা বানু অভিনীত ‘সকাল-সন্ধ্যা’ নামক বাংলা নাটকও বেশ জনপ্রিয় হয়। সেখান থেকে আজাদের মাথায় আইডিয়া আসে, দেশি তারকাদের নিয়ে পোস্টার ও কার্ড বানালে কেমন হয়। কিন্তু একজন ফেরিওয়ালার পক্ষে তারকাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা মোটেও সহজ ছিল না। তাই একদিন তিনি যখন দেখলেন, ‘তারকালোক’ ম্যাগাজিনের একটি সংখ্যার প্রচ্ছদে পীযূষ-আফরোজার ছবি, তিনি সেখান থেকেই বানালেন পোস্টার। সেই টিভি নাটকটি এতই জনপ্রিয় ছিল, প্রচুর মানুষ সেসব পোস্টার ও পিনআপ কিনতে শুরু করে। এরপর সাড়া জাগায় জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী জুটি আফজাল হোসেন-সুবর্ণা মুস্তাফার ছবিসংবলিত ভিউকার্ড। এতে আজাদের ব্যবসারও প্রসার ঘটতে থাকে। আবুল কালাম আজাদ বলেন, কাবা শরিফ, মদিনা শরিফ, ফুলসহ আরও অনেক সিনারি ব্যাংকক থেকে এনে আমরা বিক্রি করতাম এবং বাংলাদেশে তখন স্পেন ৮২ ওয়ার্ল্ড কাপের খেলা চলছে। তখন ফুটবলের ম্যারাডোনা, জিকো, রসি অনেক জনপ্রিয় ছিল। তখন আমার ধারণা হলো বিদেশি ছবি, পোস্টার, নায়ক-নায়িকারা যদি এত জনপ্রিয় থাকে, তবে আমি যদি আমার দেশের নায়ক-নায়িকাদের ছবি দিয়ে পোস্টার তৈরি করতে পারি তাহলে মনে হয় আরও ভালো হবে। যদিও আমার আইডিয়া হলো কিন্তু এর মধ্যে আবার সমস্যা দেখা দিল। ওই সময়ের যারা নায়ক-নায়িকা আমি তাদের কাছে কীভাবে যাব এমন প্রশ্ন মনে বাসা বাঁধতে থাকে। তখন ওই পত্রিকা অফিসে চলে যাই। তাদের বলি ওই ছবিগুলো দিয়ে আমি ভিউকার্ড করতে চাই। পরে ছবিগুলো সংগ্রহ করে ব্যাংকক থেকে স্ক্যানিং করে আনি। তখন বাংলাদেশে প্রথম ভিউকার্ড তৈরি হয়। একপর্যায়ে আমাদের যে ফুটপাতের দোকান ছিল সেখানে টানিয়ে রাখতাম। চকবাজারের যারা এই ব্যবসা করে তখন ইন্ডিয়ান ও বিদেশি ভিউকার্ড নিত। তাদের কাছে কিছু ভিউকার্ড ছেড়ে দিলাম। এরপর থেকে প্রসারটা বিরাট আকারে বেড়ে যায়। ৫ হাজার কার্ড দিলে তারা দুই দিন পরে এসে বলে ১০ হাজার দেন। এতই জনপ্রিয়তা ছিল এই কার্ডের। এই জনপ্রিয়তা দীর্ঘসময় ছিল। আবুল কালাম আজাদ বলেন, যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর মানুষ ভিউকার্ড কেনেন না। আজাদ প্রোডাক্টসের সেই সোনালি দিন আর নেই। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় শুভেচ্ছা কার্ডের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, ভিউকার্ডের দিন অনেক আগেই শেষ হয়েছে, কমেছে ক্যালেন্ডার, ডায়েরিরও চাহিদা। প্রযুক্তির দ্র“ত অগ্রগতির কারণে পারসোনাল কার্ডগুলোর চাহিদা এখন কমে গেছে। তবে বিয়ের কার্ড, সরকারি-বেসরকারি অফিসের কার্ড এখন কিছুটা চাহিদা রয়েছে। পারসোনাল কার্ড ৯০ শতাংশ বিক্রি কমে গেছে। ঈদের কার্ড, শুভেচ্ছা কার্ড স্মার্ট ফোনে পাওয়া যাচ্ছে। এখন মানুষ যেহেতু হাতের নাগালে সবকিছু পাচ্ছে তখন মানুষ আর কষ্ট করতে চায় না। আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমার যত অর্জন, সফলতা সব ভিউকার্ড থেকে এসেছে। এখন হোয়াটসঅ্যাপ-মেসেঞ্জারে পাঠিয়ে দেওয়া মানুষের একটা অভ্যাস তৈরি হয়েছে। একসময় মানুষ ৩০০০-৫০০০ কার্ড অর্ডার দিত, এখন সেটি অনেক কম দেয়। ৪৬ বছরে পিছিয়ে যাইনি, প্রযুক্তির কারণেই ব্যবসায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে।