একটি চলচ্চিত্র খুব ভালো ব্যবসা করলেও সংশ্লিষ্ট প্রযোজকরা বলেন, ‘লাভের টাকা দেখিনি’। প্রদর্শকদেরও একই অভিযোগ। সর্বশেষ চলতি বছর রমজানের ঈদে মুক্তি পাওয়া ‘বরবাদ’ ছবিটি ব্লকবাস্টার হিট হয়েছে এ কথা সবাই জানেন। প্রচার আছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ ছবিটি ২৭ কোটি টাকারও বেশি ব্যবসা করেছে। তারপরও শোনা যাচ্ছে এ ছবির প্রযোজনা সংস্থা নাকি বলছে ছবিটি ৫ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। চলচ্চিত্র প্রযোজকদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ- চলচ্চিত্র পরিবেশনার নানা ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির কারণে তাঁরা প্রাপ্য টাকা পান না। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে তাহলে ‘চলচ্চিত্র ব্যবসায় লাভ করে কারা’। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, বাংলা সিনেমা দেখতে এখন সিনেমা হলে ছুটছে দর্শক। কিন্তু কার্যকর বক্স অফিস না থাকায় প্রযোজকের লাভের গুড় খেয়ে নিচ্ছে অন্যরা। হলিউড-বলিউডের মতো বক্স অফিস পদ্ধতি থাকলে বাঁচবেন প্রযোজক। ১৯২২ সালে সংবাদমাধ্যম ‘ভ্যারাইটি’ হলিউড সিনেমার আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করা শুরু করে। তবে বাংলাদেশে এখনো বক্স অফিস ব্যাপারটিই তৈরি হয়নি। ফলে সাধারণ দর্শক এ নিয়ে ধোঁয়াশার মধ্যে থাকেন। দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্রনির্মাতারা দাবি করে আসছেন এ ‘চুরি’ ঠেকাতে বক্স অফিস চাই। চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের কথায়, বক্স অফিস দিয়ে সিনেমার বাণিজ্যিক অবস্থা ব্যাখ্যা করা হয়, আর এ বাণিজ্যিক দিক বিশ্লেষণ করেই রায় দেওয়া হয় সিনেমাটি হিট নাকি ফ্লপ। একটি সিনেমার সবচেয়ে বেশি আয় হয় সাধারণত হলের টিকিট বিক্রি থেকে। ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আয়নাবাজি’ সিনেমাটি ব্যবসাসফল হয়েছিল। এ সিনেমার পরিচালক অমিতাভ রেজা পরে জানান, মাল্টিপ্লেক্সের বাইরের হলগুলো থেকে কত আয় করেছে তার সঠিক চিত্র তাদের কাছে নেই। এমনকি আয়ের যে অঙ্কটা দেখানো হয়েছে, সে অনুযায়ী অর্থও প্রযোজক পাননি। এ অস্বচ্ছতার সুযোগে অনেক হল মালিক ও পরিবেশক সিনেমার আয় বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলেন। কারণ, তারা জানেন সেটাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো পর্যাপ্ত তথ্য কারও হাতে নেই। বাংলাদেশে চলচ্চিত্র ব্যবসায় বক্স অফিস না থাকার বিষয়টি ভালোভাবে দেখছেন না পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান চলচ্চিত্র প্রযোজক অশোক ধানুকা। তাঁর কথায়- বাংলাদেশের এত বছরের সমৃদ্ধ সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি আছে অথচ বক্স অফিস নেই। সংশ্লিষ্টরাই চায় না বক্স অফিস হোক। টেকনিক্যালি বলতে গেলে বক্স অফিস তৈরি করতে ছয় মাসও লাগবে না। ই-টিকেটিং সিস্টেমটা টেকনোলজিনির্ভর করলেই হয়। সিনেপ্লেক্সে আছেও। কিন্তু আপনি জানবেন না কয় টাকার টিকিট বিক্রি হয়েছে। বাংলাদেশে সিনেমা মুক্তি দিতে গেলে একজন প্রযোজককে প্রচুর ঝামেলা পোহাতে হয়। এরপর প্রযোজক দেখেন তাঁর লগ্নিকৃত টাকা অন্যের মাঝে ভাগ হচ্ছে। কিন্তু তিনি কিছু করতে পারেন না। সারা বিশ্বে বক্স অফিস আছে। স্বচ্ছতা আছে। সেটা বাংলাদেশে সিনেমা মুক্তির ক্ষেত্রে নেই। আমাদের এখানে (ভারতে) ফিফটি ফিফটি শেয়ার হয় প্রযোজক ও হল মালিকের মধ্যে। বাংলাদেশে মনে হয় ২০ শতাংশও পায় না প্রযোজক। হল মালিকরা এসি বিল, ঝাড়ুদার বিল, এই বিল সেই বিল করে হয়তো ২০ শতাংশ নিচ্ছে। আর প্রযোজককে ২০ শতাংশ দিচ্ছে। কিন্তু বাকি যে মেইনটেন্যান্স বিল নেয় সেটাও কিন্তু প্রযোজকের টাকা দিয়েই। এটা কোনো কথা? প্রযোজকের হিসাবে ১৯ কোটি টাকা আয় করেছিল ১৯৯৫ সালে মুক্তি পাওয়া সালমান শাহ-শাবনূর অভিনীত এটলাস মুভিজের ‘স্বপ্নের ঠিকানা’। ছবিটির প্রযোজক নাকি এখনো পাঁচ-ছয় কোটি টাকা পান পরিবেশকদের কাছে। কাকরাইলের পরিবেশক ও প্রযোজকদের অফিসে এ ছবির উদাহরণ টানা হয় প্রায়ই। ‘মনপুরা’র ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। প্রযোজক এখনো অনেক টাকা পাননি। অভিযোগের তীর পরিবেশনার সঙ্গে যুক্ত পরিবেশনা সংস্থার ম্যানেজার, বুকিং এজেন্ট, হল রিপ্রেজেন্টেটিভ ও হল মালিকদের বিরুদ্ধে। প্রযোজকদের মতে, তাঁদের সবার যোগসাজশে ছবির আয় নানাভাবে কম দেখানো হয় বা প্রযোজককে তাঁর প্রাপ্য টাকা দেওয়া হয় না। সাধারণত ঢাকার বাইরের হলগুলোতে আয়ের ফিফটি ফিফটি শেয়ারে একটা ছবি ভাড়া দেওয়া হয় হল মালিককে। ধরা যাক, মফস্বলে একটি সিনেমা হলে এক সপ্তাহে সর্বমোট আয় হয় ৪ লাখ টাকা। হিসাব অনুযায়ী প্রযোজককে ২ লাখ টাকা অগ্রিম দেওয়া হলো। নিয়ম অনুযায়ী ওই ৪ লাখ টাকার বেশি এক টাকাও যদি টিকিট সেল হয় তাহলে তার অর্ধেক প্রযোজক পাবেন। অনেক হল মালিক এ সেলটা দেখাতে চান না, উল্টো কমিয়ে দেখান। এজন্য তাঁরা পরিবেশনা সংস্থা কর্তৃক নিযুক্ত প্রতিনিধিকে [হল রিপ্রেজেন্টেটিভ] হাত করেন। মাত্র ৫ হাজার টাকা ঘুষ দিলেই কাজ হয়। যদি এক দিনে ৫০ হাজার টাকা সেল হয় তখন প্রযোজককে প্রতিনিধি জানান, ২০ হাজার টাকা সেল হয়েছে। এতে হল মালিকের নগদ ২৫ হাজার টাকা বাড়তি আয়। অন্যদিকে প্রযোজকের অর্ধেক আয় কমে যায়। আরও অভিযোগ, কোনো কারণে ছবি মুক্তির প্রথম সপ্তাহে যদি সেল কম হয় তাহলে পরের সপ্তাহে ওই ছবির রেন্টাল অনেক কমিয়ে বলেন বুকিং এজেন্ট ও পরিবেশনা সংস্থার ম্যানেজার। কোনো হলের রেন্টাল যদি হয় ১ লাখ টাকা, তাহলে ম্যানেজার প্রযোজকের উপস্থিতিতে বুকিং এজেন্টের সঙ্গে দরকষাকষির পর ৭০ হাজার টাকা ধরা হয়। সঙ্গে সঙ্গে রেন্টালের ১০ শতাংশ অর্থ কমিশন বাবদ বুঝে নেন বুকিং এজেন্ট। এই যে কমিয়ে রেন্টাল ধরা হলো, এর জন্য এজেন্টের কাছ থেকে ৫-১০ হাজার টাকা কমিশন নেন ম্যানেজার। পরে দেখা যায়, বুকিং এজেন্ট ঠিকই ১ লাখ টাকা হল মালিকের কাছ থেকে নিয়েছিলেন। ফলে একই সঙ্গে হল মালিক ও প্রযোজক দুই পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বুকিং এজেন্ট সমিতি কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘প্রতিটা ব্যবসায় ভালো-খারাপ দুই ধরনের লোক আছে। অনেক সময় হল মালিক অগ্রিম টাকা দিতে পারেন না। তখন আমরা পুঁজি খাটাই। সপ্তাহ শেষে তাঁরা আমাদের ফেরত দেন। আর ১০ শতাংশ নয়, আমাদের কমিশন গ্রস সেলের ওপর ৫ শতাংশ।’ অভিযোগ আছে, কিছু হল মালিক তাঁদের প্রতিশ্রুত অঙ্কের টাকাও প্রযোজককে দেন না। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ দেশের নামকরা হল মালিকদের বিরুদ্ধে। ‘মনের মাঝে তুমি’, ‘খোদার পরে মা’, ‘লাভ ম্যারেজ’সহ অনেক ছবি দেশের নামকরা সিনেমা হল মালিকের কাছে টাকা পায় বলে অভিযোগ রয়েছে। সিনেমা হল মালিক সমিতির কর্মকর্তা মিয়া আলাউদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, ‘একটা ছবি সিনেমা হলে নেওয়ার আগে হল মালিকের সঙ্গে বুকিং স্লিপের মাধ্যমে প্রযোজকের চুক্তি হয়। কত টাকা অগ্রিম দেবে কিংবা সপ্তাহ শেষে কত শতাংশ শেয়ার দেওয়া হবে। এ ধরনের অনেক অভিযোগ পাই। কিন্তু এখন পর্যন্ত এগুলো নিয়ে বসার পরে একটা অভিযোগও ধোপে টেকেনি।’