বাংলাদেশে মৎস্য ব্যবসায়ী হলেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাপস একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবেই পরিচিত। বিশ্বের অন্তত চারটি দেশে তার বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি রয়েছে। নিজের সন্তানদের উচ্চশিক্ষা দিচ্ছেন লন্ডনে। সিঙ্গাপুরে তার বাড়ি আছে। যুক্তরাজ্য, দুবাই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও রয়েছে তার বাড়ি। দুবাইতে করেছেন শপিং মল, সিঙ্গাপুর এবং লন্ডনে দুটো লিগ্যাল কনসাল্টিং ফার্মের মালিক তাপস। নিজের স্ত্রী এবং পুত্রের নামে তিনি এই বিপুল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। আর এসব সম্পত্তি করেছেন লুটের টাকায়। দেশে সম্পত্তির দিকে মনোযোগী না না হয়ে তাপস সব সময় বিদেশেই সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
অনুসন্ধানে তাপসের বিদেশে সম্পদ সম্পর্কে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিদেশে তাপস নিজেকে তালিকাভুক্ত আইনজীবী হিসেবে নাম লিখিয়েছেন। লন্ডনে যেমন তাপসের একটি ল ফার্ম ২০১৩ সাল থেকে কাজ করছে। এই ল ফার্মটি তাপসের মালিকানাধীন হলেও এতে কাজ করেন বিভিন্ন বাঙালি এবং বিদেশি আইনজীবী। তাপস এত দিন এই ল ফার্ম দেখাশোনা করতেন না। তবে ৫ আগস্টের পর এখন লন্ডনে এই ল ফার্মটি তিনি নিজেই দেখাশোনা করছেন। নিয়মিত অফিসে যান। বিভিন্ন আইনি বিষয়ে পরামর্শ দেন। মূলত অবৈধ অভিবাসীদের জন্য আইনি পরামর্শ দেয় এই ফার্মটি। এ ছাড়াও সিঙ্গাপুরে রয়েছে তার বাড়ি। সেখানে তার বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে। সিঙ্গাপুরে তার বাড়ির প্রাক্কলিত মূল্য প্রায় ২৭ কোটি টাকা ধরা হয়েছে। তবে একটি সূত্র বলেছে, একটি নয়, সিঙ্গাপুরে তার একাধিক বাড়ি রয়েছে। ৩ আগস্ট তাপস বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। তাকে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি জানিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের পতন অনিবার্য। এজন্য তাকে দেশত্যাগ করতে হবে। তাপস চলে যাওয়ার পর তার অবৈধ অর্থের উৎস সন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদক তাপসের ২৭টি ব্যাংকের হিসাবে ৫৩৯ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার ২৭৮ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের সন্ধান পেয়েছে। বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অসংগতিপূর্ণ ৭৩ কোটি ১৯ লাখ ৬৭ হাজার ৩৭ টাকা মূল্যের সম্পদ রয়েছে বলে প্রাথমিক হিসাবে জানিয়েছে।
অনুসন্ধানে ২৭টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট পর্যন্ত তার আয়ের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ ৩০৪ কোটি ৩৩ লাখ ৫৮ হাজার ৫২৮ টাকা জমা হয় এবং ২৩৪ কোটি ৮২ লাখ ৬৬ হাজার ৭৫০ টাকা উত্তোলন করা হয়। এ ছাড়া তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে ৫ লাখ ১৭ হাজার ৫২৭ ডলারের অস্বাভাবিক লেনদেন দেখা গেছে। অন্যদিকে তাপসের স্ত্রী আফরিন তাপসের ৯টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৭০ কোটি ৮৯ লাখ ৯৩ হাজার ৬৬৯ টাকা এবং ২ লাখ ২ হাজার ২৫৯ ডলারের অস্বাভাবিক লেনদেন করেছেন। তবে দুর্নীতি দমন কমিশন তার প্রাক্কলিত যে হিসাব করেছে সেই হিসাবে তার মোট অবৈধ অর্থের যৎকিঞ্চিৎ বলেই মনে করছে পর্যবেক্ষক মহল। কারণ শুধু সিটি করপোরেশন থেকেই তাপস ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি দুর্নীতি করেছেন বলে নিশ্চিত তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও মধুমতি ব্যাংকের মাধ্যমে এবং অন্যান্য নানা প্রক্রিয়ায় তাপস আরও অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা লুট করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এসব লুটের সামান্য টাকাই তিনি দেশে রেখেছেন। বাকি সব টাকা তিনি বিদেশে পাচার করেছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিঙ্গাপুরে একাধিক বিনিয়োগে অর্থ ঢেলেছেন ফজলে নূর তাপস এবং তার স্ত্রী আফরিন তাপস। সিঙ্গাপুরে অল রিয়েল এস্টেট, সিঙ্গাপুর হসপিটালস লিমিটেড, এভিয়েশন সিঙ্গাপুর এ তিনটি প্রতিষ্ঠানে তাপসের বাংলাদেশি টাকায় ১৬৭ কোটি টাকার শেয়ার রয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে। তাপস প্রায় সময় সিঙ্গাপুরে যেতেন। ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট তিনি ঢাকা থেকে প্রথমে সিঙ্গাপুরে যান। সিঙ্গাপুরের সেই সম্পদগুলো এখনো অক্ষত রয়েছে। সিঙ্গাপুরে তার এবং তার স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে। ব্যয়বহুল অর্চার্ট রোডেই এই দুটি ফ্ল্যাটের একটি ৩৮০০ স্কয়ার ফিট, অন্যটি ২৮৫০ স্কয়ার ফিট বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। এ ছাড়াও সিঙ্গাপুরের মেরিনা বে-তে তাপস নির্মীয়মাণ একটি ফ্ল্যাটের মালিকানা নিয়েছেন বলেও একটি সূত্র দাবি করেছে। সিঙ্গাপুর ছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরাতে তাপসের পাচারকৃত অর্থের ঠিকানা পাওয়া গেছে। সিঙ্গাপুরের মতো মালয়েশিয়াতেও শেখ ফজলে নূর তাপস দুটি অ্যাপার্টমেন্টের মালিক হয়েছেন। এই অ্যাপার্টমেন্ট দুটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র বলছে, তাপসকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে সম্পদ গড়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন সাবেক পলাতক বিদ্যুৎ, জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। মূলত নসরুল হামিদ বিপুর সাহচর্যেই দুবাইতে দুটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন তাপস। তবে তাপসের দ্বিতীয় স্থায়ী ঠিকানা হলো লন্ডন। যেহেতু তিনি লন্ডনে বার-অ্যাট ল করেছেন সেজন্য তিনি লন্ডনে একজন তালিকাভুক্ত আইনজীবী হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। এ সুযোগটি নিয়ে ২০১১ সালে তিনি সেখানে একটি ল ফার্ম প্রতিষ্ঠা করেন। এই ল ফার্মে এখন আটজন আইনজীবী রয়েছেন। ইস্ট লন্ডনের অল গেটে অবস্থিত এই ল ফার্মটি দেখাশোনা করে তাপসের নিজস্ব লোক। তবে ৫ আগস্টের পর থেকে এই ল ফার্ম তাপসই দেখাশোনা করছেন বলে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। এ ছাড়াও লন্ডনে কিংস স্টোনে তার একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে, যে অ্যাপার্টমেন্টে তিনি থাকেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও সাউথ লন্ডনে তাপস আরেকটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন বলে একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে।
একটি সূত্র দাবি করেছে, স্কটল্যান্ডে তাপস একটি রেস্টুরেন্টে বিনিয়োগ করেছেন। এই রেস্টুরেন্টটি দেখাশোনা করেন তাপসের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি মিজান। এই মিজান তাপসের সংসদ নির্বাচনের সময় সহযোগিতা করেছিলেন। তারপর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান এবং তাপসের অবৈধ সম্পদগুলো দেখভাল করা, সেগুলোকে বৈধতা দেওয়াই তার প্রধান কাজ ছিল বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এ ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় তাপসের সম্পত্তি রয়েছে বলে জানা গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ আছে বলেও জানা গেছে।
বিভিন্ন সূত্রগুলো জানাচ্ছে যে, তাপস প্রতি বছর তিনবার করে বিদেশে যেতেন। প্রতি বছর তার বিদেশের রুট ছিল একই। তিনি এখান থেকে প্রথমে সিঙ্গাপুর যেতেন। সিঙ্গাপুর থেকে তিনি যুক্তরাজ্য যেতেন। যুক্তরাজ্য থেকে যেতেন যুক্তরাষ্ট্রে এবং ফেরার পথে তিনি দুবাইতে থাকতেন এবং দুবাইতে ব্যবসাবাণিজ্য, সব অবৈধ টাকার লেনদেনের কাজগুলো চূড়ান্ত করে তারপর তিনি দেশে ফিরতেন। তার অন্তত চারটি বিদেশ ভ্রমণের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিবারই তিনি একই রুটে বিদেশে গেছেন এবং এসেছেন। এ থেকে বোঝা যায়, অবৈধভাবে অর্জিত লুটের টাকা বিদেশে রাখার জন্যই তাপস এরকমভাবে এ রুটগুলো ব্যবহার করতেন।
দেশে তাপসের আইন পেশা ছিল। তবে মেয়র হওয়ার পর তিনি আইন পেশায় যেতেন না। আইনি ব্যবসা থেকে তার কোনো আয় ছিল না বলেই তিনি পরবর্তীতে জানিয়েছেন। মেয়র হিসেবে যে বেতন পেতেন, সেই বেতনের টাকায় তিনি কীভাবে বিদেশে সম্পদের পাহাড় করেছেন এটি নিয়ে প্রশ্ন হয়। তবে বিভিন্ন সূত্র বলছে, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থই তিনি বিদেশে পাচার করেছেন। আর এ অর্থগুলোর একটি অংশ তিনি বাংলাদেশে নিয়েছেন, যেখানে তিনি নিজেকে মৎস্য খামারি হিসেবে ভুয়া পরিচয় দিয়েছেন। অন্যদিকে বিদেশে পাচারকৃত অর্থগুলো তার হিসাবের বাইরে রেখেছেন। এসব অর্থ নিয়ে তাপস এখন আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করছেন। যদিও তাপস পালিয়ে যাওয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশন তার ৫৩৯ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন নিয়ে তদন্ত করছে। কিন্তু বাস্তবে তার লুটপাটের টাকার পরিমাণ অনেক বেশি। সেই অবৈধ অর্থ পুরোটাই বিদেশে। তাপসের বিদেশে রাখা সম্পদের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত দুদক, সিআইডি বা বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।