প্রতি বছর ৯ আগস্ট পালিত হয় আদিবাসী দিবস। দিবসকে কেন্দ্র করে তিন পার্বত্য জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি হয়ে ওঠে উত্তপ্ত। পাহাড়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে উপজাতি সন্ত্রাসীরা নামে সশস্ত্র সংঘর্ষে। খুন, গুম, অপহরণ আর চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ে তারা। এবারও আদিবাসী দিবসকে সামনে রেখে এরই মধ্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে তিন পার্বত্য জেলা। দুই দিন আগে খাগড়াছড়ির গভীর জঙ্গলে দুই সশস্ত্র গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হয় চারজন। এক দিন পরেই গতকাল পানছড়িতে ইউপিডিএফ ও জেএসএস এর মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়ে অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রসহ শক্তিশালী ওয়াকিটকি পর্যন্ত উদ্ধার করেছে। দিবসটাকে কেন্দ্র করে তিন পার্বত্য জেলায় এখন থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে।
স্থানীয়রা জানান, এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপজাতি ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো খুবই তৎপর। তারা প্রায়ই মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পার্বত্য অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। এসব মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর ফলে জাতিগত সংঘাত তৈরির সম্ভাবনা দেখা যায়। এ সুযোগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তারা দেশবিরোধী প্রচারণাও চালিয়ে থাকে। পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে কাজ করা বিশ্লেষকরা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, দিবসটা সামনে এলেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আদিবাসী বিতর্ক উসকে দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদে উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং নৃগোষ্ঠী উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়াও পার্বত্য শান্তিচুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে ‘উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসেবে বর্ণিত আছে এবং আঞ্চলিক ও জেলা পরিষদের বিভিন্ন ধারায় ‘উপজাতি’ শব্দটি বলবৎ থাকবে বলে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ রয়েছে। জাতিসংঘ সনদ ২০০৭ এ আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র এবং আইএলও কনভেনশন ১০৭ ও ১৬৯ ধারাতে আদিবাসী নাগরিকদের নিজস্ব এলাকায় আত্মনিয়ন্ত্রণ ও ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠার বিষয়সমূহ পার্বত্য অঞ্চলের উপজাতিদের জন্য বেশি সুবিধাজনক হবে। বিষয়টি অনুধাবনের পর থেকে তারা আদিবাসী স্বীকৃতির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলেন, ২০০৭-২০০৮ সালের আগে উপজাতীরা কখনোই নিজেদেরকে আদিবাসী হিসেবে দাবি করেনি। ১৯৯৭ সালে স্বাক্ষরিত শান্তি চুক্তিতে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে উপজাতি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে। ২০০৮ সালে চাকমা সার্কেল চিফ ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা থাকা অবস্থায় তার অধীনে থাকা পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় হতে চিঠির মাধ্যমে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয় যে বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই। এদিকে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পার্বত্য আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে সশস্ত্র সংঘাতের পরিমাণ ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আঞ্চলিক দলগুলোর সশস্ত্র সংঘাতের কারণে পাহাড়ে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সংঘর্ষে লিপ্ত দলের সদস্যদের পাশাপাশি পাহাড়ের সাধারণ মানুষও আহত-নিহত হচ্ছে। পার্বত্য অঞ্চলের ব্যবসাবাণিজ্য ও পর্যটন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিগত ১ বছরে সশস্ত্র দলগুলোর মধ্যে ৮৯টি গুলির ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে ৪৫ জন আর আহত ৫৭ জন। নিহতদের মধ্যে উপজাতি ৪২ জন আর বাঙালি তিনজন। এসব ঘটনায় ৩৯ জন উপজাতি আহত হয়েছে আর বাঙালি ১৮ জন।
আর মাত্র কয়েক দিন পরেই পালিত হবে আদিবাসী দিবস। এরই মধ্যে তিন পার্বত্য জেলায় শুরু হয়েছে নীরব চাঁদাবাজি। দুর্গম পাহাড়ে আধিপত্য নিয়ে চলছে সশস্ত্র সংঘর্ষ। সামনে পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে স্থানীয় গোয়েন্দারা। এসব প্রসঙ্গে খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এ বি এম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এ বিষয়ে আমরা সচেতন ও সতর্ক রয়েছি। যখন যে পরিস্থিতি উদ্ভব হয় সেটা বিবেচনা করে পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় এখানে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে। আমরা এখানে নিজেদের মতো করে সমন্বয় করে কাজ করে থাকি। জেলা প্রশাসক বলেন, বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতির সম্পর্ক সেটা এখন পর্যন্ত মেইনটেইন করতে সক্ষম হয়েছি। বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর যে সব প্রতিনিধি আছেন তাদের সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করি। সম্প্রীতি কমিটির সভা করি। এর অন্যতম কারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন ঠিক থাকে। এদিকে পাহাড়ের সংঘাত ঠেকাতে শান্তিচুক্তির পুনর্মূল্যায়ন জরুরি বলে জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা বলেন, পার্বত্য শান্তিচুক্তি যে প্রেক্ষাপটে জাতীয় সংসদের অনুমোদনবিহীনভাবে সম্পাদিত হয়েছিল তা নিয়ে বিভিন্ন বিতর্ক রয়েছে। এই শান্তিচুক্তির অনেক ধারাই সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তিন পার্বত্য জেলায় বসবাসরত বাঙালিদের অধিকার এবং আকাক্সক্ষা এই চুক্তিতে প্রতিফলিত হয়নি। সময়ের বিবর্তনে এই চুক্তিরও সংস্কার করার সুযোগ রয়েছে বলে পার্বত্য এলাকায় বসবাসরত বাঙালিরা মনে করেন।