প্রজনন মৌসুমের কারণে জুন থেকে আগস্ট এই তিন মাস সুন্দরবনে মাছ, কাঁকড়া, মধু, গোলপাতা ও গরান কাঠ থেকে শুরু করে সব ধরনের বনজ সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ থাকে। এমনকি বনকে বিশ্রাম দিতে এ সময়ে বনের অভ্যন্তরে পর্যটকদেও আগমনসহ পর্যটন বাণিজ্যও বন্ধ থাকে। বলতে গেলে এ সময়টা বন থাকে অনেক সুনসান নিরিবিলি। পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত বনকর্মীসহ আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতি ছাড়া কোন কোন বনজীবির এ সময়ে বনে অবস্থানের বৈধ সুযোগ নেই।
অবশ্য এক শ্রেণির অসাধু বনজীবীর এই সময়টাই গোপনে সুন্দরবনে অপকর্ম করে। এ সময়ে জেলে বা বনজীবী নামধারী এসব অসাধু ব্যক্তিরা সুন্দরবনের অভ্যন্তরের বিভিন্ন খালে ও নদীতে নানাভাবে বিশেষ করে নিষিদ্ধ জালের মাধ্যমে বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার করে। আবার অনেকে গহীন অরণ্যে অবৈধ পন্থায় ধরা চিংড়িসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ গাছের মাচার ওপর চাটাই বিছিয়ে তার নিচে কাঠ পুড়িয়ে আগুনে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করে। পরে তা সময় সুযোগ মতো বস্তায় ভরে নদীপথে বিভিন্ন শহরে বিক্রির জন্য চালান করে দেয়।
বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি জুলাই মাসে বনের গহীনে অসাধু চক্রের গড়ে তোলা বেশ কয়েকটি শুঁটকি তৈরির মাচা বনকর্মীরা ভেঙে ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ গত ২৩ জুলাই পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের চরাপুটিয়ার জংগলের শিয়ালা খালের আগায় বনপ্রহরীরা শুঁটকি ঘরের সন্ধান পেয়ে ২ বস্তা শুঁটকি, ৩ টি নৌকা, ৩টি ড্রাম জব্দ করে শুঁটকি ঘর গুঁড়িয়ে দেয়। ১৫ জুলাই চরাপুটিয়া এলাকায় ৪টি শুঁটকি ঘর ভেগে দেয়াসহ ২০ বস্তা শুঁটকি জব্দ করেছে চাঁদপাই রেন্জের স্মার্ট টিম-১ এর সদস্যরা।
আগের দিন ১৪ জুলাই শরণখোলা রেঞ্জের স্মার্ট পেট্রোলিং টিম সুপতি স্টেশনের বড় কেচুয়া খালে অভিযান চালিয়ে একটি শুঁটকি শুকানোর রং ঘর ধংস করে। ১২ জুলাই দুপুরে হাড়বাড়িয়ার বড় ডাবুর খালের মুখে দুইটি নৌকাসহ ১৮ বস্তা শুঁটকি মাছ জব্দ করা হয়। এসব অভিযানে বেশ কয়েকজনকে ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করা হয়।
বিষ দিয়ে মাছ ধরার সাথে জড়িত স্থানীয় কয়েকজন জেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বনের মধ্যে জোয়ারের পানিতে খাল ভরে উঠলে দুই প্রান্তে ছোট ফাঁসযুক্ত ভেশালি দিয়ে ফাঁদ পাতা হয়। এরপর ভাটার টানে পানি নামতে শুরু করলে ওই ফাঁদের মধ্যে কীটনাশক ঢেলে দিলে কিছুক্ষণের মধ্যে চিংড়ি ভেসে ওঠে, সেগুলোই ধরা হয়। এরপর সুন্দরবনের মধ্যে গাছ কেটে তৈরি করা হয় ফাঁকা জায়গা। সেখানে কেটে রাখা সুন্দরী, পশুর, গেওয়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির কাঠ সাজিয়ে বিশেষ কায়দায় বানানো হয় মাচা। এসব মাচার ওপর চাটাই বিছিয়ে তার ওপর চিংড়ি ও অন্যান্য মাছ রেখে নিচে কাঠ পুড়িয়ে আগুন দেওয়া হয়। আগুনের তাপে বিষ দিয়ে ধরা মাছ শুকিয়ে তৈরি করা হয় শুঁটকি।
বনসংলগ্ন গ্রামগুলোয় গিয়ে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিষ দিয়ে ধরা চিংড়ি সরাসরি লোকালয়ে আনা হয় না, পাইকারি বাজার ও খোলাবাজারে বিক্রি হয় না। তাই জেলেরা বনের গভীরে মাচা বানিয়ে চিংড়ি শুকিয়ে তবেই পাচার করেন। সুন্দরীগাছের কাঠে আগুন দিলে শুঁটকি লালচে হয়, বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায়। এ কারণে সুন্দরী গাছই বেশি কাটা হচ্ছে। একসময় কয়রার লোকালয়েও এমন শুঁটকির কারখানা ছিল। বনবিভাগ ও প্রশাসনের যৌথ অভিযানে কয়েক বছরে অন্তত ৩০টি কারখানা ধ্বংসের পর কারবারটি এখন পুরোপুরি বনের গভীরে চলে গেছে। সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি ভারতেও এ শুঁটকি পাচার হয়ে থাকে। সুন্দরবনের আংটিহারা রুট দিয়ে ভারতে চলাচলকারী বিভিন্ন কার্গো ও লাইটার জাহাজগুলোই সুন্দরবনের বিষ শুঁটকি পাচারের গোপন মাধ্যম। এসব জাহাজে গোপনে শুঁটকি তুলে দেওয়া হয়।
জেলেদের সূত্র জানায়, প্রজনন মৌসুমের নিষিদ্ধ সময়ে শুধু অপরাধীরা গোপনে গহীন বনে ঢুকে বিষ ছিটিয়ে চিংড়ি ধরে। সেই চিংড়ি লোকালয়ে আনা যায় না বলে বনের ভেতরেই মাচা বানিয়ে আগুনে শুকিয়ে শুঁটকি করে চুপিচুপি শহরে পাচার করা হয়। এ চক্রের সাথে বনবিভাগের এক শ্রেণির অসাধু সদস্যদের মাসিক নির্দিষ্ট টাকার চুক্তি রয়েছে।
মোংলা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোঃ শাহীন বলেন, বিষ দিয়ে ধরা মাছ খেয়ে বন্যপ্রাণী মারা যাওয়ার পাশাপাশি মানুষের শরীরেও এর প্রভাব পড়ছে। মাছের মধ্যে বিষের প্রভাব পড়ায় শরীর নানা রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে।
পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক দীপক চন্দ্র দাস বলেন, কিছু অসাধু জেলে সুন্দরবনের গহিনে কীটনাশক ছিটিয়ে চিংড়ি ধরেন। পরে গাছ কেটে আগুনে শুকিয়ে বানান শুঁটকি।
পূর্ব সুন্দরবনের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ রেজাউল করিম চৌধূরী বলেন, ‘এবার বন্ধ মৌসুমে আমরা অপরাধীদের স্বস্তিতে থাকতে দিচ্ছি না। শুঁটকি মাচা বেশি ধ্বংস হচ্ছে। তবে গহিন বনে বিষ দিয়ে চিংড়ি ধরা আর মাচা বানানো খুবই উদ্বেগজনক। এতে বন ও জীববৈচিত্র্য দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। টহল বোটের শব্দ পেলেই অপরাধীরা পালিয়ে যায়, আবার জনবলও কম। তারপরও আমরা অপতৎপরতা রোধে কঠোর হচ্ছি।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল