ভরা মৌসুমেও লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় জেলেদের জালে দেখা মিলছে না কাঙ্খিত রুপালী ইলিশ। সারা দিন নদীতে জাল ফেলে অধিকাংশ জেলেদের ফিরতে হচ্ছে শুন্য হাতে। নদীতে মাছ না পাওয়ায় আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছেন অর্ধলক্ষাধিক জেলে পরিবার। কাঙ্খিত মাছ না পাওয়া এখন জেলে পরিবারগুলোর মাঝে বিরাজ করছে চরম হতাশা। এদিকে, ইলিশের আমদানি কম থাকায় অলস সময় পার করছেন আড়ৎদাররা। এতে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন মৎস্য ব্যাবসায়ী ও আড়ৎদাররা।
জেলেরা জানান, ইলিশের এখন ভরা মৌসুম। জাল ভরে উঠে আসা কথা রুপালী ইলিশ। কিন্তু মেঘনায় জেলেদের জালে দেখা মিলছে না রুপালী ইলিশ। এমন বাস্তবতায় চরম আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছেন লক্ষ্মীপুরে জেলে পরিবারগুলো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরে মাছ শিকার করে জীবিকা আহরণ করছেন প্রায় ৬৫ হাজার জেলে। তবে এর মধ্যে নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন ৪৬ হাজার ৬৭ জন।
জেলেরা বলছেন, এক একটি নৌকায় ১০ থেকে ১২ জন জেলে নদীতে সারাদিন জাল টেনে ফিরছেন প্রায় শুন্য হাতে। এতে খরচের টাকার মাছও মিলছেনা তাদের। নদীতে কাঙ্খিত মাছ না পেয়ে আর্থিক সংকটের মুখে পড়ে পরিবারের মুখে দু-মুটো খাবার তুলে দিতেও এখন হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
কমলনগর উপজেলার মতিরহাট এলাকায় জেলে রুবেল বলেন, নদীতে এখন ইলিশ পাওয়া যাচ্ছেনা। অথচ আগে এসময়ে আমাদের জালে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ত। নদীতে মাছ না পাওয়ায় আমাদের সংসার চালাতে খুব কষ্ট হচ্ছে । তিনি আরও বলেন, একেকবার নদীতে যেতে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়। অথচ নদী থেকে ফিরে মাছ বিক্রি করতে হয় ১৫’শ থেকে দুই হাজার টাকার। এতে মহাজনের দেনায় শোধ করতে পাছেননা তারা।
এই এলাকার ছালাম মাঝি বলেন, নদীতে যে মাছ পাই তাতে আমাদেরই পেট বাঁচেনা। ছেলে-মেয়েসহ পরিবারতো অনেক দুরের কথা। এরপরও নদীতে যেতে হয়। কারণ এটাই আমাদের পেশা। অন্য কোন কাজ না পারায় বাধ্য হয়েই আমাদের নদীতে যেতে হয়। এদিকে মৎস্য ব্যবসায়ী ও আড়ৎদাররা বলছেন, ভরা মৌসুমে মাছ না থাকায় লক্ষ্মীপুরের মাছ ঘাটগুলোতে নেই হাঁকডাক। প্রতিদিন যেসব আড়তে লাখ লাখ টাকার ইলিশ বিকিকিনি হতো, সেগুলোতে নেমে এসেছে স্থবিরতা।
সদর উপজেলার মজুচৌধুরীর হাট মাছ ঘাটের আড়ৎদার নাছির উদ্দিন রিয়াজ বলেন, নদীতে নাব্য সংকট থাকায় এখন ভরা মৌসুমে মেঘনায় দেখা মিলছেনা রুপালী ইলিশ। এখন ইলিশ শূন্য মজু চৌধুরীর হাট মাছ ঘাট। আমরা এখন পুঁটি মাছ, চিংড়ি মাছ ও ভাঢা মাছ বিক্রি করে কোন রকম জীবকিা নির্বাহ করছি। আমরা যেমন দাদন দিয়ে খুব অসহায় অবস্থায় আছি, তেমনি জেলেরাও পড়েছেন বিপাকে। মাছ না পাওয়ায় নদীতে জেলেরা একদিন গেলে পরের দিন আর যেতে চায় না। তেলের পয়সাও ওঠে না তাদের।
কমলনগরের মতিরহাট মাছ ঘাটের ব্যবসায়ী আবদুল মতিন বলেন, লাখ লাখ টাকা জেলেদের দাদন দিয়েছি, নদীতে মাছ না পাওয়া এখন অলস সময় পার করতে হচ্ছে আমাদের। এতে চরম আর্থিক সংকটে পড়েছি আমরা।
মতিরহাট মাছ ঘাটের সভাপতি আবদুল খালেক মেম্বার বলেন, নদীতে মাছ না থাকায় জেলেদের অবস্থাও করুন, আড়ৎদারদের অবস্থাও করুন। আড়ৎদাররা এখন শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছেন। অথচ আগে এই সময়েমাছ ঘাটে প্রতি দিন লাখ লাখ টাকার ইশি কেনা-বেচা হতো। এখন তা নেমে এসেছে হাজারে। ড্রেজিং এর মাধ্যমে নদীর নাব্যতা না ফিরালে অদুর ভবিষ্যৎ-এ মেঘনায় আর ইলিশের দেখা মিলবেনা বলে আশংকা তার।
মেঘনা পাড়ের মৎস্য ব্যবসায়ী আলমগীর মোল্লা, জুলফিকার ও জেলে আলী আহমেদ, রবিউলসহ কয়েকজন জানান, নদীতে ইলিশ খুবই কম। ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধি ও জাটকা সংরক্ষণে বছরে আড়াই মাস নদীতে নিষেধাজ্ঞা থাকে। এরপরও নদীতে ইলিশ বাড়েনি। এক একটি নৌকা সারাদিন জাল মেরে চার থেকে পাঁচটি, বড়জোর আট থেকে ১০টি ছোট ইলিশ পাচ্ছে। ইলিশ উৎপাদন কম বলেই দাম বাড়ছে। ইলিশ শিকার করলেও তাদের পাতে জোটে না।নদীতে ইলিশের উৎপাদন বাড়লে জালেও বেশি ধরা পড়ত, দামও নাগালের মধ্যে হতো।
ইলিশ উৎপাদনের বিষয়ে তারা অভিযোগ করেন, ‘এসি রুমে বসে মনগড়া হিসাবে প্রকৃত তথ্য আড়াল করছে মৎস্য বিভাগ। মাঠ পর্যায়ে কোনো তথ্যই কেউ সংগ্রহ করছে না। অথচ প্রতি বছর ইলিশ উৎপাদন বাড়ছে মৎস্য অধিদপ্তর রিপোর্ট প্রকাশ করছে।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরে গত অর্থবছরে (২০২৩-২০২৪) ইলিশ উৎপাদন হয়েছে ২৩ হাজার টন। মাছঘাট রয়েছে ২৫টি। এতে প্রতিদিন জেলায় ৮২ টন ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল। ২৫টি ঘাটের প্রতিটিতে গড়ে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন টন বা সাড়ে তিন হাজার কেজি ইলিশ উৎপাদন হয়।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ বিল্লাল হোসেন বলেন, সমুদ্রে ইলিশ ধরা পড়লেও জলবাযু পরিবর্তন, নাব্যতা সংকট ও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাবে লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় জেলেদের জালে দেখা মিলছেনা রুপালী ইলিশ। পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হলে আগামী মাসের শেষের দিকে জেলেদের জালে ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশাবাদ এই মৎস্য কর্মকর্তার।
বিডি প্রতিদিন/এএম