স্পেন ইউরোপের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অবস্থিত। যার ইতিহাসে ইসলামী শাসনের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় রয়েছে। খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় ৮০০ বছর স্পেন ছিল মুসলিম শাসকদের অধীনে। সে সময় এ অঞ্চল ‘আন্দালুসিয়া’ নামে পরিচিত ছিল, যা কেবল একটি ভৌগোলিক নামই নয়, বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল ছিল।
ইসলামী শাসনের দীর্ঘকালীন প্রভাব স্পেনের স্থাপত্য, শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিতে এক উজ্জ্বল চিহ্ন রেখে গেছে। যদিও দুঃখজনকভাবে পরবর্তী সময়ে অনেক মসজিদ গির্জায় রূপান্তরিত করা হয় এবং ইসলামী ঐতিহ্য মুছে ফেলার চেষ্টা চালানো হয়, তবে এখনো এমন কিছু ইসলামী স্থাপনা ও নিদর্শন টিকে আছে, যেগুলো স্পেনের ইতিহাসের এক অনন্য নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আলহামরা প্রাসাদ
আন্দালুসিয়ার ঐতিহ্যের জ্যোতি। গ্রানাডা শহরের উঁচু পাহাড়ে অবস্থিত আলহামরা প্রাসাদ, যা ‘পান্না মুক্তা’ নামেও পরিচিত স্পেনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটন আকর্ষণ এবং ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর এক অতুলনীয় নিদর্শন।
এটি শুধু স্পেন নয়, বরং গোটা বিশ্বের সেরা আরবীয় প্রাসাদগুলোর অন্যতম হিসেবে স্বীকৃত। আলহামরা প্রাসাদ তার অপরূপ কারুকাজ, জ্যামিতিক নকশা, মনোরম উদ্যান এবং ঝরনার ছন্দোময় সৌন্দর্যের মাধ্যমে অষ্টম থেকে পঞ্চদশ শতকের ইসলামী শিল্প, সংস্কৃতি ও শাসনের গৌরবময় ইতিহাসকে তুলে ধরে। ঐতিহাসিক প্রাসাদটি বর্তমানে ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা অর্জন করেছে এবং এখানে প্রতিবছর অসংখ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও সংগীত উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আলহামরার মধ্যে বেশ কিছু বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক অংশ রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য : দ্য রয়েল প্যালেস—রাজকীয় বাসভবন, যেখানে রাজারা রাজনীতি ও প্রশাসন চালাতেন; প্যাটিও দে লা রেইনা—রানিদের জন্য নির্মিত ছিল এই অপূর্ব খোলা প্রাঙ্গণ; কোমারেস টাওয়ার—যা মূলত শাসকের আসন ও অভ্যর্থনাকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

টোরে দেল ওরো (সোনার টাওয়ার)
আন্দালুসিয়ার সেভিল ও সমগ্র আন্দালুসিয়ার নদীপথ নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে মধ্যযুগে এই টাওয়ারটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিরক্ষা স্থাপনা। একদিকে এটি কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো, অন্যদিকে দক্ষিণ আমেরিকা ও ভারত থেকে সমুদ্রপথে আসা মূল্যবান ধাতু, বিশেষ করে সোনা ও রুপা সংরক্ষণে নিরাপদ কেন্দ্র হিসেবে কাজ করত। এ থেকেই টাওয়ারটির নামের উৎপত্তি ‘সোনার টাওয়ার’। ইসলামী স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে টোরে দেল ওরো এখনো দাঁড়িয়ে আছে অতীতের গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
পরবর্তীকালে এটি রূপান্তরিত হয়েছে একটি নৌ-ঐতিহ্যবাহী জাদুঘরে, যা এখন পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে আসা দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে। এই জাদুঘরে রয়েছে : মধ্যযুগীয় নৌবাহিনীতে ব্যবহৃত আলোকযন্ত্র ও যন্ত্রাংশ, আমেরিকা অন্বেষণের সময় ব্যবহৃত জাহাজের মডেল (বিশেষত পঞ্চদশ শতাব্দীর) এবং সপ্তদশ শতাব্দীর কামান, যা সে সময়কার সামরিক শক্তির চিহ্ন বহন করে।

জাফেরিয়া প্রাসাদ
জাফেরিয়া প্রাসাদ, স্পেনের জারাগোজা শহরে অবস্থিত এক অনন্য ইসলামী স্থাপত্য নিদর্শন, যা নির্মিত হয় ১১ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, জারাগোজার আমিরের শাসনামলে। এটি ছিল একাধারে একটি প্রতিরক্ষামূলক দুর্গ এবং বিনোদন ও রাজকীয় বাসস্থানের স্থান, যা সে সময়কার আন্দালুসীয় মুসলিম সংস্কৃতির সমৃদ্ধ সৌন্দর্যকে প্রতিফলিত করে। তাইফা যুগের ইসলামী স্থাপত্যের বিরল নিদর্শন জাফেরিয়া প্রাসাদ। অত্র অঞ্চলে এটাই ছিল একমাত্র সংরক্ষিত ইসলামী স্মৃতিস্তম্ভ। প্রাসাদটির কাঠামো ছিল চতুর্ভুজাকার, যা ঘিরে ছিল বেশ কয়েকটি গোলাকৃতি টাওয়ার। এর মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত ও বিশেষ টাওয়ারটি হলো ‘টাওয়ার অব দ্য ট্রুবাদুর’, যা পরবর্তীকালে সাহিত্য, সংগীত ও কল্পকাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
কর্ডোবা মসজিদ
স্পেনের কর্ডোবা শহরে অবস্থিত কর্ডোবা মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, বরং এটি ইসলামী স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অনন্য প্রতীক। প্রায় আড়াই শতাব্দী ধরে নির্মিত এই বিস্ময়কর মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ৯২ হিজরিতে (৭১১ খ্রিস্টাব্দ), যখন উমাইয়া বংশ কর্ডোবা জয় করে এবং এখানেই গড়ে তোলে আন্দালুসিয়ার রাজধানী। মূলত এই মসজিদকে বলা হতো ‘জামি আল-হাদরা’ তথা খলিফার মসজিদ। তবে দুঃখজনকভাবে খ্রিস্টান শাসনামলে ঐতিহাসিক এই মসজিদকে একটি ক্যাথেড্রালে রূপান্তরিত করা হয়। বর্তমানে এটি ‘ক্যাথেড্রাল-মসজিদ’ নামে পরিচিত। মসজিদের গম্ভীর সৌন্দর্যের মধ্যে আছে সুনিপুণ খোদাই, মার্বেলের স্তম্ভ, লাল-সাদা খিলান এবং বিস্ময়কর মিনার। এ ছাড়া এর বিখ্যাত কমলাগাছের চত্বর, যা প্রশান্তির প্রতীক হিসেবে দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে।
সেভিলের আলকাজার
ইসলামী শিল্পকলা ও ঐতিহ্যের প্রহরী। স্পেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর সেভিলের গুয়াদালকুইভির নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন সামরিক প্রহরী টাওয়ার। এটি নির্মিত হয়েছিল আল মুহাম্মদ খিলাফতের শাসনামলে, ইসলামী স্থাপত্য ও শিল্পকলা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সেভিলের আলকাজার অবধারিতভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এর অপূর্ব কারুকাজ, সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যবাহী সাজসজ্জা আলকাজারকে এক অনন্য মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। এই প্রাসাদ নিয়ে ইতিহাসবিদ ও পর্যটকদের মধ্যে নানা কাহিনি প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, এটি ছিল একটি প্রাচীন ইসলামী দুর্গ, যাকে পরবর্তীকালে বিভিন্ন যুগে সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হয়। প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করলে চোখে পড়ে জ্যামিতিক নকশায় অলংকৃত দেয়াল, খাঁজকাটা খিলান, সুসজ্জিত বাগান ও ঝরনা, যা একদিকে যেমন ইসলামী রুচির পরিচয় বহন করে, তেমনি অন্যদিকে অন্দরের সৌন্দর্যে এনে দেয় এক অনুপম ঐশ্বর্য।
আল-জাহরা শহর
আল-জাহরা কর্ডোবা শহর থেকে কিছুটা পশ্চিমে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক শহর, যা এক সময় ছিল ইসলামী শাসনের রাজকীয় প্রতীক। খলিফা আবদুর রহমান আন-নাসির এই নগরীর নির্মাণকাজ শুরু করেন, যার নির্মাণকাজ শেষ হতে সময় লাগে প্রায় ২৫ বছর। এই নগরীর হৃদয়ে নির্মিত হয়েছিল এক রাজপ্রাসাদ, যা রাজকীয় ঐশ্বর্য ও নান্দনিক কারুশিল্পের অপূর্ব সমন্বয়। প্রাসাদের দেয়ালগুলো ছিল সোনায় মোড়ানো, আটটি বৃহৎ প্রবেশদ্বার তৈরি করা হয়েছিল হাতির দাঁত ও আবলুস পাথর দিয়ে। সেগুলো সজ্জিত ছিল দামি রত্ন ও স্বর্ণখচিত অলংকরণে। শহরজুড়ে ছিল বিশাল বাগান, সুইমিং পুল, জলপ্রপাত, বিদেশি পাখির খাঁচা, রাজকীয় প্রশাসনিক ভবন এবং মার্বেল পাথরে নির্মিত অপূর্ব ঝরনাসমূহ। খলিফা আবদুর রহমান আন-নাসির এই শহরে একটি মসজিদও নির্মাণ করেছিলেন, যা ছিল গম্বুজ, খাঁজকাটা খিলান এবং দুর্দান্ত মার্বেল স্তম্ভে সমৃদ্ধ। একাদশ শতাব্দীতে বারবার বাহিনী এই সমৃদ্ধ নগরী আক্রমণ করে, লুটপাট করে এবং শেষ পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেয়। দীর্ঘদিন এই প্রাসাদ ও নগরীর ধ্বংসাবশেষ মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল। ২০১৮ সালের ১ জুলাই ইউনেসকো আল-জাহরাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে।