গত জানুয়ারি মাস থেকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের নামে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে তুলকালাম চলছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজের সঞ্চালনায় দিনের পর দিন বৈঠক চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। রাষ্ট্র সংস্কারের চুলচেরা বিশ্লেষণ করছেন। দাঁড়ি, সেমিকোলন নিয়ে আলোচনা করছেন। রাষ্ট্র সংস্কারে কী থাকবে, কী থাকবে না তা নিয়ে তর্কবিতর্ক হচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে রাজনৈতিক বিভাজন। দেখে মনে হচ্ছে সব পণ্ডিত যেন একত্রিত হয়েছেন রাষ্ট্রকে বাঁচানোর জন্য। তাদের কথা শুনলেই যেন দেশ উদ্ধার হবে, না হলে হবে সর্বনাশ। রাষ্ট্র সংস্কারের নিত্যনতুন আবিষ্কার তাদের যেন আপ্লুত করছে। তারা সাগর সেচে মুক্ত খুঁজে বের করছেন। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই?
রাষ্ট্র সংস্কারের এ তোড়জোড় এবং তৎপরতা দেখে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতার কথা মনে পড়ল। ‘জুতা আবিষ্কার’ কবিতায় যেমন- পায়ে যেন ধুলো না লাগে সেজন্য করণীয় উদ্ধার করতে উজির, মন্ত্রী, পাইক, পেয়াদারা গলদঘর্ম হয়ে গেলেন, রাজা উত্তেজিত কিন্তু শেষে দেখা গেল চামারেই সহজ সমাধান, জানালেন চরণ দুটি চামড়া দিয়ে মুড়ে দিলেই ধুলো থেকে মুক্ত হওয়া যায়। সেই নগণ্য ব্যক্তির পরামর্শ থেকেই উত্তরণ ঘটল এক মহাসংকটের। এখন রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে যেভাবে তোলপাড় চলছে, তাতে জুতা আবিষ্কারের কথাই মনে পড়ে। কারণ ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই বিএনপির পক্ষ থেকে ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় যে বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছিল, ড. আলী রীয়াজ, বদিউল আলম মজুমদাররা সে বিষয়গুলো নিয়েই দিনরাত একাকার করছেন। সেগুলোকে নানারকম রঙে রঙিন করে বিচিত্র ঢংয়ে উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন। অথচ রাষ্ট্র সংস্কারের এ বিষয়গুলো আগেই আলোচিত এবং উপস্থাপিত। দেশের প্রায় সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এ নিয়ে ঐকমত্যও পোষণ করেছিল।
বিএনপির ৩১ দফার উৎস কী? ২০১৮-এ রাতের ভোট নির্বাচনের পর বিএনপি অনুধাবন করতে পারে যে, এ সরকারের অধীনে আর অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগ সরকার প্রশাসন, রাষ্ট্রযন্ত্রকে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে, করা হয়েছে কুক্ষিগত। আর এ কারণেই একটি স্বৈরাচারী ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল দেশজুড়ে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আওয়ামী লীগ বিচার, আইন, প্রশাসন, পুলিশ বাহিনী, আমলাতন্ত্র সবকিছু দলীয়করণ করেছিল, রীতিমতো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। আর এখান থেকে উত্তরণের একটাই পথ ছিল- তা হলো পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কার করা। এ কারণেই ২০১৮-এর পর থেকেই বিএনপি ধাপে ধাপে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলে। বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি ৩১ দফা প্রস্তাব তৈরি করেছিল। যে ৩১ দফায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপকল্প উপস্থাপন করা হয়েছিল। এটি একটি জাতীয় ঐক্যের দলিল।
৩১ দফা এমন একটি প্রস্তাবনা যা রাষ্ট্র পরিচালনায় বাস্তবায়িত হলে কোনো একটি দল ক্ষমতায় এসে কর্তৃত্ববাদী হওয়ার সুযোগ থাকবে না। ক্ষমতার ভারসাম্য এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে রাষ্ট্রে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং স্বচ্ছতার ব্যবস্থা রাখা হবে, যাতে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এবার দেখা যাক, বিএনপির এ ৩১ দফা আর এখন রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যা করছে, তার মধ্যে বিরোধ কোথায়? রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাবে সংবিধানের যে মৌলিক সংস্কারের বিষয়গুলো নিয়ে কথা হচ্ছে, তার মধ্যে অন্যতম প্রধান বিষয় হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বিএনপির ৩১ দফার দ্বিতীয় দফাতেই বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে স্থায়ী সাংবিধানিক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে একটি নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাপনা করা হবে।’ অর্থাৎ এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটাই বিএনপির ৩১ দফাতে আছে, যা প্রায় সব স্বৈরাচারবিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই তৈরি করা।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না- এটি নিয়ে উচ্ছ্বসিত। এটি তারা আবিষ্কার করেছে- এমন একটি প্রচারণা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই বিএনপির যে ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার প্রস্তাব, তার চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে ‘পরপর দুই টার্মের অতিরিক্ত কেউ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না।’ সে সময় বিএনপি সব রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করেই এটি প্রণয়ন করে। বর্তমান রাষ্ট্র সংস্কারে সাত মাস পরিশ্রম, অর্থ খরচ এবং খাওয়াদাওয়ার পর বলা হয়েছে যে, একটি উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অথচ বিএনপির রাষ্ট্র সংস্কারের পঞ্চম দফায় আছে- ‘বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের সমন্বয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার লক্ষ্যে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, পেশাজীবী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও প্রশাসনিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে সংসদে উচ্চকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তন করা হবে।’
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বর্তমানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৩টি বৈঠক করেছে। এ নিয়ে নানা রকম জটিলতা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ। তিনি রীতিমতো মাথার ঘাম পায়ে ফেলছেন বলেও বলা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ মনে করতে পারে যে, কী প্রচণ্ড পরিশ্রম তিনি করেছেন! অথচ ৩১ দফার ছয় দফাতেই বলা হয়েছে- ‘আস্থা ভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তা প্রশ্ন জড়িত- এমন সব বিষয় ব্যতীত, অন্য সব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত প্রদানের সুযোগ করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখা হবে, বিবেচনা করা হবে।’ অর্থাৎ এটির ব্যাপারেও আগেই রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ বিষয়টি নিয়ে সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করেই বিএনপি ৩১ দফা প্রণয়ন করেছিল। এখন প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়েও বিতর্ক চলছে। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে মনে হচ্ছে যেন বিভক্তির ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ নিয়েও ৩১ দফায় বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দুই বছর আগেই। বিএনপির ৩১ দফার তৃতীয় দফায় বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা ও দায়িত্ব সুসমন্বয় করা হবে। লক্ষণীয় ব্যাপার যে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ পদ্ধতি নিয়েও কথাবার্তা বলেছে। কিন্তু বিএনপির যে ৩১ দফা কর্মসূচি রয়েছে, তাতে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ আইন ২০২২ সংশোধনের কথা বলা হয়েছে।
এখন যেমন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেই সিদ্ধান্ত ২০২৩ সালেই বিএনপির পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছে, যেসব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে যে রাষ্ট্র সংস্কার পদ্ধতি এবং ব্যবস্থা সম্পর্কে একটি সুনির্দিষ্ট খসড়া দলিল তৈরি করা হয়েছে, তাহলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কেন সাত মাস সময় নষ্ট করল? কীসের আশায়, কোন কারণে তারা এ সময় ওই একই বিষয়গুলো নিয়ে চর্বিতচর্বণ করছেন? আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে জল ঘোলা করল? রাষ্ট্র সংস্কারের সবচেয়ে সহজ উপায় ছিল বিএনপি যে ৩১ দফা ঘোষণা করেছিল, সেই ৩১ দফা যদি টেবিলে নেওয়া হতো এবং এটির ভিত্তিতে সব রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্রণ জানানো হতো, ৩১ দফার প্রতিটি দফা ধরে ধরে যদি তারা আলোচনা করতেন যে, কোনটার সঙ্গে একমত, কোনটা করা যায়, কোনটা করা যাবে না- তাহলে এক মাস সময়ের মধ্যে রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়টি সম্পন্ন হয়ে যেত। তৈরি হয়ে যেত জুলাই ঘোষণা। কারণ একটি তৈরি করা দলিল যেখানে আছে, সেখানে নতুন করে প্রতিটি বিষয় নিয়ে সাত মাস বৈঠক করার কী অর্থ থাকে তা আমার অন্তত বোধগম্য নয়।
এক্ষেত্রে দুটি বিষয় বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। প্রথমত, বিএনপি ৩১ দফা এককভাবে তৈরি করেনি। বরং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে এই খসড়া দলিলটি তৈরি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিএনপি কখনোই বলেনি যে, ৩১ দফাই চূড়ান্ত। এটির কোনো পরিবর্তন পরিমার্জন হবে না। এটি একটি প্রস্তাবনা। যা আলোচনা ও ঐকমত্যের ভিত্তি। আর এখানেই প্রশ্নটি এসে যায় যে, একটি রাজনৈতিক দল যখন দীর্ঘ পরিশ্রম করে, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে একটি দলিল তৈরি করে, তখন সেই দলিলকে মর্যাদা দেওয়া উচিত। এর ফলে রাষ্ট্রের এ বিপুল অর্থ অপচয় এবং সময়ক্ষেপণ হতো না।
এখন ড. আলী রীয়াজ বা বদিউল আলম মজুমদাররা যেভাবে প্রতিটি বিষয় আবিষ্কারের মতো করে তুলে ধরছেন এবং এটি নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামতের নামে সময়ক্ষেপণ করে নির্বাচনকে অনিশ্চিত করে তুলছেন। রাজনৈতিক দলগুলো সংস্কার চায় না- এমন একটি আবহ তৈরি করছেন, কার স্বার্থে? এটি করতে গিয়ে এখন ঐকমত্য কমিশনের বিজ্ঞ সুশীলরা জুতা আবিষ্কারের মতো একেক দিন একেক প্রস্তাব উপস্থাপন করছেন।
আমি বিশ্বাস করতে চাই না যে, যারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আছেন, তারা ৩১ দফা সম্পর্কে কিছু জানতেন না। ৩১ দফা সম্পর্কে জানার পরও তা পাশ কাটিয়ে তারা যে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে ঝড় তুলছেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে বিভক্ত করছেন সেটির পেছনে কোনো অশুভ উদ্দেশ্য আছে কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার। নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া, নির্বাচনকে অনিশ্চিত করা এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে ফাটল ধরার কোনো গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ কি না তাও এখন ভেবে দেখার সময় হয়েছে।