পান-সুপারি, সুই-সুতা থেকে জাহাজ, গার্মেন্টস, রড-সিমেন্ট, আবাসন ব্যবসায় পর্যন্ত পদে পদে বাধা। কেবল বাধা নয়, পেছনে টেনে ধরার ফলে চরম বিপর্যয়ের শিকার ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা। একদিকে তাঁদের অর্থনীতির রিয়াল হিরো বলে পিঠ চাপড়ানো হচ্ছে, আরেক দিকে ভিলেন বানানোর অপতৎপরতা। মামলা-হামলা-হয়রানি ও করারোপের তোড়ের নিষ্ঠুর তামাশা তাঁদের সঙ্গে।
এসব মসকরার পরিণতিতে ব্যবসা-বিনিয়োগের প্রায় প্রতিটি খাতেই রক্তক্ষরণ। নতুন বিনিয়োগ দূরে থাক, লগ্নি করা বিনিয়োগই ঝুঁকিতে। এক বছর ধরে নতুন কর্মসংস্থানের বদলে কর্মচ্যুতি-ছাঁটাই চলমান। নতুন নতুন বেকার; যা দেশে অনিশ্চিত অর্থনীতির এক প্রতিচ্ছবি।
অর্থনৈতিক এ বাস্তবতায় সবচেয়ে বেশি চাপে ব্যবসায়ীরা। প্রণোদনার পরিবর্তে তাঁরা বেদনায় নীল হচ্ছেন করনীতি, ব্যাংকঋণের অপ্রতুলতা ও আমদানি-রপ্তানি জটিলতায়। এমনকি ব্যবসায়ীদের অনেকের ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পর্যন্ত জব্দ। জিন্দা মেরে ফেলার মতো ক্রমাগত ঘটনাগুলোর দহনে তৈরি হয়েছে আস্থার সংকট।
ব্যবসায়ীদের প্রশ্ন, আর কত টুঁটি চেপে ধরলে শেষ হবে এ নিপাতন? অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে যাওয়ায় নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ স্তব্ধ। যেটুকু ছিল সেখানেও ছন্দঃপতন। কর্মচ্যুতি-ছাঁটাইয়ে নয়া বেকার যোগ। এই স্তব্ধতায় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অনিশ্চয়তায় ডুবসাঁতার দিয়ে কোনো মতে টিকে আছেন। আর তরুণ প্রজন্মের চাকরির বাজার ছারখার।
অনির্বাচিত, অন্তর্বর্তী, মধ্যবর্তী, অস্থায়ী সরকারে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক কোনো সেক্টরেই স্থিতাবস্থা আসে না, তা স্বতঃসিদ্ধ। বাংলাদেশের বাস্তবতা আরো ভিন্ন। যা ছিল তা-ও রক্ষা হচ্ছে না। সবখানেই খরা। তলানিতে পড়তে পড়তে প্রায় সবই অতলে। প্রশ্ন উঠছে, এ কি অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, নাকি নীতিনির্ধারণে অদক্ষতা-অনিশ্চয়তার ফল? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে কিন্তু ভিন্ন অভিজ্ঞতা। শ্রীলঙ্কা মারাত্মক অর্থনৈতিক ও ঋণ সংকটে পড়েও উের গেছে। সেখানে ব্যবসায়ীদের ওপর ধকল আসেনি। ব্যবসায়ী বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে মব ভর করেনি। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে তব্দা করার দমননীতি দেখা যায়নি। নেপালেও তাই। দেশটি দীর্ঘদিন রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভুগেছে। কিছুটা বাংলাদেশের আদলেই রাজনৈতিক পট পাল্টেছে দেশ দুটিতে। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যে এমন প্রাতিষ্ঠানিক দমন-পীড়ন হয়নি কোনো দেশেই। বরং দেশ দুটির নতুন সরকার ব্যবসায়ীদের সহায়তা নিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। নিত্যপণ্যের বাজার থেকে পুঁজিবাজারসহ জাতীয় অর্থনীতি গতিময় করেছে ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীদের একান্ত সহায়তায়। বাংলাদেশে ঘটেছে একদম বিপরীত।
অন্তর্বর্তী বা অস্থায়ী সরকারের সময় উন্নয়ন প্রকল্প ধীরগতির হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু এবার সেই ধীরগতি স্থবিরতায় রূপ নিয়েছে। ব্যবসায়ীদের নাজেহাল করা, মব সওয়ার হওয়া, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, পুরো বাণিজ্য পরিবেশে আঘাত করা। তা শুধু দেশীয় নয়, বিদেশি বিনিয়োগকারীদেরও দূরে ঠেলে দেয়। দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিকে ভেঙে ফেলছে। এ ক্ষত সারানো বড় কঠিন। ব্যবসা, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান অর্থনীতির প্রাণ। সামাজিক স্থিতিশীলতার ইন্ডিকেটর। কোনো দেশ বা সমাজের ব্যবসায়ী-বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ না থাকলে অর্থনীতির শিরায় রক্ত সঞ্চালন হবে না। পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোই ঝুঁকিতে পড়বে।
শ্রীলঙ্কা বা নেপালের উদাহরণ আমাদের দেখায়, অর্থনৈতিক সংকট কাটানোর অন্যতম দাওয়াই ব্যবসা-বিনিয়োগের নিশ্চয়তা। ব্যবসায়ীদের টুঁটি চেপে ধরলে দেশ দুটিতেও বাংলাদেশের দশাই হতো। বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে পুনরুজ্জীবন দিতে হলে এখনই আস্থা ফেরানো, নীতিগত স্বচ্ছতা আনা এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা জরুরি। নইলে বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ যে অনিশ্চয়তার দোলাচলে পড়েছে, ভবিষ্যতে নির্বাচিত-জনপ্রিয় সরকার এসেও একে লাইনে তুলতে বহুমুখী সমস্যায় পড়বে।
বছরখানেকেরও বেশি সময় ধরে চলা ব্যবসায়ীদের হয়রানি, অ্যাকাউন্ট জব্দ, মববাজি, প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা অর্থনীতিকে আরো অচল করে দিচ্ছে। তা দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ইতিহাসে প্রায় নজিরবিহীন। অর্থনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আস্থা। ব্যবসায়ীরা যখন দেখেন তাঁরা নিজেরা অনিরাপদ, তাঁদের মূলধনও ক্ষতিগ্রস্ত, তখন কোনো মতে নাক ডুবিয়ে টিকে থাকা বা পারলে ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে পালানোকেই উত্তম ভাবেন। কিন্তু চাহিবা মাত্রই ব্যবসার ঝাপি নামানো সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তিল তিল করে যুগের পর যুগ শ্রমে-ঘামে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান হুট করে বন্ধ করা মুখের কথা নয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এ ব্যাপারে আরো সতর্ক। পরিস্থিতি এমন থাকলে কলিজা দেওয়ার লোভনীয় অফারেও তাঁরা গলেন না। যার নমুনা আমরা নিয়মিতই দেখছি।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে স্বচ্ছ ও ব্যবসাবান্ধব নীতি আরো বেশি জরুরি। দেশি ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে ভরসা পেলে বিদেশিরা বিনা দাওয়াত বা অফার ছাড়াই ছুটে আসবেন। মায়াবি-দরদি আহবান জানাতে হবে না। এ সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের আলাপ-সংলাপ নেহাতই কম। প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে অন্যান্য উপদেষ্টাসহ সরকারের অংশীজনরা কত মহলের সঙ্গে বসছেন, কথা বলছেন। কোনো কোনো দল বা মহলের সঙ্গে বারবারও বসছেন। কিন্তু বিজনেস কমিউনিটির সঙ্গে সে ধরনের কোনো সংযোগের খবর নেই।
সরকার ও নীতিনির্ধারকদের শুরু থেকেই উচিত ছিল উদ্যোক্তাদের এভাবে বেখবরে না রাখা। তাঁদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা। সংলাপ করা। শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। কার্যকর প্রণোদনা দিতে না পারলেও অন্তত বিনিয়োগকৃত পুঁজির নিশ্চয়তা দেওয়া। তেমনটি হলে উৎপাদন-উন্নয়ন-বিনিয়োগের সমান্তরালে কর্মসংস্থানের একটি জোয়ারও তৈরি হতে পারত। বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় শ্রমশক্তি হচ্ছে তরুণ জনগোষ্ঠী। জনসংখ্যার এক বিশাল অংশই এখন কর্মক্ষম বয়সে। গেল সরকারের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনটির সূচনা হয়েছিল কর্মসংস্থান প্রশ্নেই। কোটা নয়, মেধার ভিত্তিতে চাকরির দাবি ছিল তাঁদের প্রধান দাবি।
বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিবছর লক্ষাধিক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হলেও সে অনুযায়ী চাকরি তৈরি হয় না। সরকারি চাকরির সংখ্যা সীমিত, আর বেসরকারি খাতও বিনিয়োগ সংকটে ভুগছে। ফলে নতুন চাকরির বাজার স্থবির। তাদের কর্মসংস্থানের মূল বাজার বেসরকারি খাত। সেখানেই এখন আকাল। কর্মদাতারাই সংকটে। পদে পদে নিগৃহীত, অপমানিত। তাঁরা বুঝে উঠতে পারছেন না, কী করবেন? এ বেদনা নিয়ে কোথায় কার কাছে যাবেন?
ঢালাওভাবে ব্যবসায়ীদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করে সার্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য, দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলা হয়েছে। দুর্বল শাসনব্যবস্থায় অর্থনীতি চলতে পারে না। সঠিক রাজনীতি ছাড়া সঠিক অর্থনীতিও হয় না। তার ওপর ব্যবসায়ীদের গড়পড়তা বা হরেদরে প্রতিপক্ষ বানানো প্রকারান্তরে অর্থনীতিকে চাবুক মারার নামান্তর। গলায় পাড়া দিয়ে বা টুঁটি চেপে ধরে গোঙানির শব্দ বের করা যায়। তা শুনতে কিছু লোকের কাছে গীত মনে হলেও আসলে তা শুধুই বোবা কান্নার শব্দদূষণ। মামলা, হামলাসহ নানা হয়রানিতে ব্যবসায়ীদের কাবু করে তাঁদের দুর্দশায় ফেলে বিকৃত আনন্দ নেয়ার সমান্তরালে অর্থনীতির সর্বনাশও কম করা হচ্ছে না।
প্রবৃদ্ধি ও শ্রমবাজারে এর কী ভয়ানক প্রভাব পড়ছে ভবিষ্যতে সেই পাটিগণিত-বীজগণিত অবশ্যই প্রকাশ পাবে। আর নগদ হিসাব তো অনেকটাই দৃশ্যমান। উৎপাদন বাড়ানো, রপ্তানি সম্প্রসারণ, নতুন ব্যবসা তৈরির অনিশ্চিত নমুনা খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ না থাকলে বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত স্থবির থাকে, প্রবৃদ্ধি কমে, কর্মসংস্থান হয় না, বেকারত্ব বাড়ে, সমাজে দেখা দেয় অসামাজিকতা। এগুলো অর্থনীতি না বোঝা মানুষও বোঝে।
এ নিষ্ঠুরতা থেকে রেহাই পেতে দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করা এবং উদ্যোক্তাদের আস্থায় আনা ও নিরাপদ রাখার বিকল্প নেই। কিন্তু করা হয়েছে তাদের ঠেঙানি দিয়ে, অপমান-অপদস্তে রাখার সহজ কাজটি। এর ফলাফল যে অবধারিত, তা এখন হাড়ে হাড়ে উপলব্ধিযোগ্য। দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি উদ্যোক্তাদের নিরাপত্তা ও আস্থা পুনঃস্থাপন ছাড়া শিল্প ও কর্মসংস্থান চাঙ্গা করা অসম্ভব। সরকার চাইলে ইমার্জেন্সি পাইলট প্রকল্পের মতো তা এখনো করতে পারে। নিতে পারে সময়োপযোগী শটকোর্স উদ্যোগ, যা ব্যবসায়ীদের দেশে থেকে নতুন বিনিয়োগ করতে উৎসাহী করবে, নিশ্চিত উৎপাদন ও রপ্তানি বাড়াবে। দেশের অর্থনীতিতে যতটা সম্ভব ফিরিয়ে আনবে চাঞ্চল্য।’
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট
ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন