কাঠামোগত বিনিয়োগ, বনাম প্রশাসানিক বিকেন্দ্রীকরণ, অর্থনৈতিক ইতিহাস এবং বাস্তব উপাত্তের নিরিখে চট্টগ্রামকে প্রায়শই দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী আখ্যা দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে এ উপাধি এখনো কেবল গালভরা পদবি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাহাড়, নদী ও সমুদ্রবেষ্টিত এ শহরটি দেশের বাণিজ্যিক হৃৎপিণ্ড, যেখানে দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়ে গেলেও ‘চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক রাজধানী’ রয়ে গেছে শুধু কাগজকলমেই। প্রশ্ন, এখন চট্টগ্রাম বাণিজ্যিক রাজধানী বাস্তবায়ন আর কত দূর? চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক ভূমিকা দেশের সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে এক অপরিহার্য ভিত্তি। এ অঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পন্ন করে। এ বিপুল বাণিজ্যিক প্রবাহের কারণে দেশের মোট রাজস্ব আয়ের শতকরা ৬০ ভাগের বেশি আসে চট্টগ্রাম থেকে। দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) চট্টগ্রামের প্রত্যক্ষ অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। স্বাধীনতার পর থেকেই, প্রায় প্রতিটি সরকার চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানীতে রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। আশির দশকে রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে প্রথম এ ধারণাটি উত্থাপিত হয়। পরবর্তী সময়ে বিএনপি সরকার চট্টগ্রামে ‘চট্টগ্রাম এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন’ প্রতিষ্ঠা করে, যা এখনো দেশের রপ্তানিমুখী শিল্পের মেরুদণ্ড। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে চট্টগ্রামকে সত্যিকারের বাণিজ্যিক রাজধানীতে পরিণত করার ঘোষণা দিয়েছিল। ‘সত্যিকারের’ বাণিজ্যিক রাজধানী করার সেই ঘোষণাও থেকে গেছে কাগজকলমে। স্বাধীনতার পর ক্ষমতায় বসা সব সরকারের আমলে নেওয়া উদ্যোগই বিচ্ছিন্ন এবং সমন্বয়হীনতার ফলে চট্টগ্রাম এখনো নামমাত্র ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ রয়ে গেছে। অনেকটাই ঠুঁটো জগন্নাথ।
বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দরের সব ক্ষমতার উৎস এখনো মন্ত্রণালয়ে কেন্দ্রীভূত। ব্যবসায়ীরা কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ঢাকামুখী হতে বাধ্য হন, যা অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ ও ব্যয়ের কারণ সৃষ্টি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাণিজ্যসংক্রান্ত যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের প্রধান কার্যালয়, বাণিজ্যিক ব্যাংক-বিমার সদর দপ্তর বা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন শাখা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত হওয়া জরুরি। এ ফর্মুলা ব্যবহার করে বিশ্বের সব উন্নত দেশ সাফল্যের শীর্ষে উঠেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মুম্বাইয়ে আন্তর্জাতিক আর্থিক কেন্দ্রগুলোর সাফল্যের মূলে রয়েছে রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এবং বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের মতো প্রধান আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সদর দপ্তর সেখানে থাকা। বাণিজ্যিক রাজধানী ফর্মুলা অনুসরণ করে চীনের সাংহাই বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক ও আর্থিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। নেদারল্যান্ডস এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশ সমুদ্রবন্দরকে সফলভাবে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করেছে। এ দেশগুলো প্রমাণ করে যে উন্নত বন্দর ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন জাতীয় সমৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি। যতক্ষণ পর্যন্ত না উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কোনো প্রাশাসনিক ব্যক্তি চট্টগ্রামে চূড়ান্ত বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার পাচ্ছেন, ততক্ষণ এ দূরত্ব ঘুচবে না। চট্টগ্রামকে পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক রাজধানী বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ১. ‘বাণিজ্যিক রাজধানী বিল’ পাস করে চট্টগ্রামের ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ মর্যাদা গেজেটভুক্ত করা। ২. আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের প্রধান কার্যালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী দপ্তর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ডেপুটি গভর্নরের কর্মস্থল চট্টগ্রামে স্থাপন করা এ ক্ষেত্রে এক ধাপ অগ্রযাত্রা হিসেবে। ৩. দুর্নীতি এবং অদক্ষ আমলাতন্ত্র নির্মূল করার জন্য কাঠামোগত সংস্কার সাধন করা। ৪. ব্যবসায়ীরা যাতে দ্রুত এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের মাধ্যমে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন তা বাস্তবায়ন করা। একই সঙ্গে চট্টগ্রামের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থানীয় নগর পরিকল্পনাবিদ এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে অপরিকল্পিত প্রকল্প বাস্তবায়ন এড়ানো। চট্টগ্রামকে সত্যিকারের বাণিজ্যিক রাজধানীতে পরিণত করার মাধ্যমেই কেবল সুষম ও টেকসই জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস নিশ্চিত করা সম্ভব। চট্টগ্রাম যদি পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক রাজধানীতে রূপ নেয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। আন্তর্জাতিক মানের অবকাঠামো, বাণিজ্য প্রশাসন ও করপোরেট সেবা গড়ে উঠলে জিডিপিতে অন্তত ২-৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যোগ হতে পারে। নতুন শিল্প, ব্যাংক-বিমা প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে চট্টগ্রাম নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গেও ব্যবসায়িক সংযোগ স্থাপন করতে পারবে। এতে শুধু চট্টগ্রাম নয়, গোটা দেশের অর্থনৈতিক মানচিত্র পাল্টে যাবে। চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানীতে রূপান্তর করা কোনো আঞ্চলিক চাওয়া নয়, এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির কৌশলগত প্রয়োজন। সময় এসেছে ঘোষণা নয়, বাস্তবায়নের। কারণ চট্টগ্রাম শুধু সমুদ্রবন্দর নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের প্রতীক।
লেখক : সাংবাদিক, বাংলাদেশ প্রতিদিন