পৃথিবী তার অক্ষের ওপর দাঁড়িয়ে সূর্যের চারদিকে ঘোরে। এ ঘূর্ণনের নামই ঋতুবৈচিত্র্য। এ নিয়মেই শীত-বসন্ত অসে। কেউ চাক বা না চাক, প্রকৃতির সাধারণ নিয়মেই পরিবর্তন সাধিত হয়ে আসছে। কেউ শীতকালকে বসন্ত বললে বা বসন্তকে শীত বললে প্রকৃতির নিয়মে কোনো ব্যত্যয় ঘটে না, ঘটার কথাও নয়। শীতে খেজুরের রস আর বসন্তে ফুলের সমারোহ- এ তো স্বাভাবিক রীতি। সে কারণেই কবি হয়তো বলেছেন, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।’ প্রকৃতির এ রীতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় স্বাভাবিকতাকে। আমরা চাইলেই পানির স্রোত উল্টে দিকে প্রবাহিত করতে পারি না। বাঁধ দিয়ে আটকানো যায়, তবে তা স্বাভাবিক প্রবাহকে রুখে দেওয়া যায় না। বাক্স্বাধীনতা মানুষের একটি স্বাভাবিক রীতি। এটি জন্মগত অধিকার। যেহেতু মানুষই একমাত্র প্রাণী, যে কথা বলে চিন্তা করে। সে কারণে মানুষের এ অধিকারের ওপর যে কোনো হস্তক্ষেপ প্রকৃতির নিয়মবিরুদ্ধ। আজকের দুনিয়ায় কোথাও কোথাও এ প্রশ্ন উঠেছে- স্বাধীনতার মাত্রা নিয়ে কথা উঠেছে সীমা কতটুকু। আসলে এটি বোধ হয় বলার অপেক্ষা রাখে না, স্বাধীনতার সীমারেখা হচ্ছে নিজের আওতা পর্যন্ত। সেই বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করা যায় শরীরের সবচেয়ে বর্ধিত অংশ নাকের ডগার স্পর্শ না করা পর্যন্ত। বলা যাবে না যে একের স্বাধীনতা অপরকে আক্রান্ত করছে। এ আলোচনা বিশ্বে ও অন্য যে কোনো প্রান্তে যা-ই হোক আমাদের মতো দেশ বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে এ স্বাধীনতার আলোচনা ও মাত্রা এক বিশেষ বাস্তবতা। আমাদের দেশে গত ৫৪ বছরের শাসন পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বারবার এই স্বাধীনতা প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছে। যাঁরা বাক স্বাধীনতার কথা বলে ক্ষমতায় গিয়েছেন তাঁরাই স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেছেন। আখেরে এ থেকে কোনো সুফল লাভ করা সম্ভব হয়নি। উপরন্তু বিপর্যয় নেমে এসেছে। বলা যায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তরই অতিক্রম করতে পারেনি আমাদের বাক্স্বাধীনতার বিষয়টি।
বৈষম্য নিরসনের আন্দোলন থেকে অর্থাৎ স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার যে লড়াই শুরু হয়েছিল তা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল। আমরা অর্জন করলাম বাংলাদেশ। এ লড়াইয়ের একটি বড় অংশ ছিল কথা বলার লড়াই, যাকে আমরা বলছি গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম। এ লড়াই কতটা মেধার সঙ্গে করতে হয়েছে এবং যারা করেছেন তারা কতটা মেধাবী ছিলেন তার ছোট্ট একটি নমুনা তুলে ধরা যাক। প্রকাশিত রিপোর্টের ধরন থেকে বোঝা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মিছিলের খবর প্রকাশে হয়তো নিষেধাজ্ঞা ছিল। সে কারণে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মধ্যবয়সি একদল যুবক হাতে বইখাতা নিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাতে কিছু বলতে বলতে এলাকা প্রদক্ষিণ করে বেরিয়ে গেল। বিষয়টি যে শিক্ষার্থীদের মিছিল সেটি বোধ করি পাগলেও বোঝে। এটি কেন করা হয়েছিল তা-ও বোঝা কষ্টকর নয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলছিল, তাকে সমর্থন করে জনমত গঠন করা ছিল মূল লক্ষ্য। জনমত গঠনই মূলত মিডিয়ার মুখ্য ভূমিকা। এজন্যই দেশ ও জাতি গঠনে মিডিয়ার স্বাধীনতা অপরিহার্য। জনমত আর প্রচলিত মত বা জনপ্রিয় মত এক না-ও হতে পারে। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি মিথ্যা শুনতে শুনতে আপনি মিথ্যাকেই হয়তো সত্যি মনে করতে পারেন, যেটিকে আমরা এখন গোয়েবলসীয় বলে থাকি। এটি অপপ্রচার, তারপরও মিডিয়া প্রশাসন হাতে থাকলে এটি করা খুব সহজ। মিথ্যার আড়ালে সত্যকে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এটি আরও বেশি হয়ে থাকে। নির্বাচন কমিশন থেকে আগামী নির্বাচনে এ আইনকে যে বিপজ্জনক বলা হয়েছে সেটিও মূলত মিডিয়া সন্ত্রাসের মধ্যে পড়ে। যা বলছিলাম তা হলো, রক্ত ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেলাম, সেখানে বাক্স্বাধীনতা রক্ষার কোনো ব্যবস্থা হলো না। সংবিধানে যা-ই বলা থাক না কেন, মূলত ’৭২ সালেই মিডিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়েছিল সেই পাকিস্তানি কুখ্যাত আইনে। মিডিয়ার ওপর এ হস্তক্ষেপ বিচ্ছিন্ন ছিল না। মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা। এ হস্তক্ষেপের নাম ছিল বাকশাল। তার আগে মিডিয়ার ওপর খড়্গ নেমে এসেছিল ১৯৭৪ সালের ১৬ জুন। সব পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে। স্বাধীনতার পর সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা ‘গণকণ্ঠ’ বন্ধের মধ্য দিয়ে যে অনধিকারচর্চার শুরু হয়েছিল, তার চূড়ান্ত পরিণতি আসে সব মিডিয়া বন্ধের মাধ্যমে। এটি মূলত আমাদের স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে যায় না, যায়নি। বাক্স্বাধীনতা বলতে কেবল মিডিয়ার স্বাধীনতাকেই বোঝায় না, মূলত এর বাস্তব প্রয়োগ হচ্ছে গণতান্ত্রিক অধিকার ভোটাধিকার প্রয়োগ। নিজের পছন্দ অনুযায়ী কাউকে ভোট দিতে পারা বা দেওয়ার মতো বাস্তব পরিবেশ তৈরি বাক্স্বাধীনতার সম্পূরক। সম্প্রতি গত সাড়ে ১৫ বছরে বাক্স্বাধীনতা হরণের যে প্রসঙ্গ উঠেছে, সেখানে ভোটাধিকারের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতায় রয়েছে। বিষয়টি কোনো একক সরকার বা কারও ব্যক্তিগত বিষয় নয়। দেখতে হবে সামগ্রিকতার মধ্যে। এ দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য আজও বিদ্যমান।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না ব্রিটিশ ভারতে সংবাদপত্র বা মিডিয়ার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই মিডিয়াকে সরকারের অনুকূলে ব্যবহারের কুপ্রথা বিদ্যমান। তখন কোম্পানির শাসকরা তাদের প্রতিপক্ষ ফরাসিদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের নিমিত্তে সেন্সরশিপের আইন প্রণয়ন করেছিল যা আজও নানান ফর্মে আরও কঠিন হয়ে বিদ্যমান। ব্রিটিশ আমলের পর আমরা পাকিস্তান অতিক্রম করেছি। এ দেশের সাংবাদিক সমাজের গণতান্ত্রিক মানুষেরা মিডিয়ার ওপর এ খড়্গ বন্ধে হাজারো মিছিল করেছে, সমাবেশ করেছে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সরকারকে বয়কট করেছে। সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। বাস্তবে এতে মিডিয়ার স্বাধীনতা রক্ষায় কোনো বাস্তব ফল দিয়েছে তা বলা যাবে না। ব্যাপারটা দেশের গণতন্ত্রায়ণেও এমনটি ঘটেছে। বলছিলাম বাকশাল আমলে মিডিয়া বন্ধের কথা। বাকশাল-পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট জিয়া ক্ষমতায়িত হলে তিনি দেশে বাকশালের দ্বারা নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দলগুলো খুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। একই সঙ্গে মিডিয়ার নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেওয়া হয়। একে একে পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়। দেখে মনে হলো, শত ফুল ফোটার যে অঙ্গীকার রয়েছে তার বাস্তবায়ন হচ্ছে। বাস্তবে এ কথা ঠিক যে প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে মিডিয়ার ওপর বলতে গেলে তেমন কোনো হস্তক্ষেপ হয়নি। অনেকখানি অবাধ স্বাধীনতা মিডিয়া ভোগ করেছে। তা কতক্ষণ। প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যার পর সময়ক্ষেপণ করে এরশাদের সামরিক শাসন আসার পর আবার ‘যেই লাউ সেই কদুতে’ পরিণত হয়। মিডিয়ার ওপর নেমে আসে লিখিত-অলিখিত নির্যাতন-নিবর্তন। লেখার স্বাধীনতা, বলার স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে গুটি কয়েক শব্দে। সংগত বিবেচনা থেকেই দেশে ভোটাধিকার হুমকির মুখে পড়ে। প্রচলিত হয় পাতানো ভোটের গল্প। এ অবস্থাটা চলে প্রায় ৯ বছর। শেষ বছরের দিকে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন সরকারের খবর বয়কট করে, সংবাদপত্রে ধর্মঘট আহ্বান করে। বাস্তবে এটা করতে হয়েছিল বাক্স্বাধীনতা আইনত রুদ্ধ থাকার কারণে। এসব ইতিহাস আমাদের অনেকেরই জানা। নতুন করে বলে লাভ নেই। এ থেকে যে বিষয় শেখার তা হলো, রক্তে কেনা স্বাধীনতায় কথা বলার স্বাধীনতা পেলাম না। এ দেশে, এ ভূমিতে যারা ক্ষমতায় এলেন তারা মানুষের মত দমনে এতটাই সক্রিয় থাকলেন যে একসময় বিখ্যাত ছড়াকার আবু সালেহ ক্ষোভে-রাগে লিখেছিলেন ‘রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এ কোন স্বাধীনতা। ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা...। আসলে মানুষ কথা বলতে চায়। তার বলার ধরন কী, কেমন হবে সে কথা পরে বিবেচ্য। আমরা যারা মিডিয়ার সঙ্গে যুক্ত, তারা এটা মনে করি সাধারণ জনগণ সব সময়ই সরকারি প্রশাসন দ্বারা নির্যাতিত। কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত। সাধারণ জনগণের এ আক্রান্ত হওয়ার খবরটি প্রকাশ করে মিডিয়া। তখনই মিডিয়া শত্রুতে পরিণত হয়। কার্যত মিডিয়ার ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতনের শামিল। এটি অন্যায়, বন্ধ হওয়া জরুরি। গত ৫৪ বছরে বাংলাদেশের মিডিয়া সবচেয়ে শান্তিতে কাজ করেছে বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলে। সে সময়ে কোনো ধরনের সেন্সরশিপ বা নিয়ন্ত্রণ ছিল না। বিগত সময়ের শাসনামল মেলালে এটা বলা যাবে বেগম জিয়া ছিলেন মিডিয়া ও গণতন্ত্রবান্ধব। সেটি সব কথা নয়। যে আইনগুলো দেশে মিডিয়ার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন করে, গণতন্ত্র হত্যা করে, সেগুলো প্রকারান্তরে বহাল রয়েছে। বাংলাদেশে মিডিয়ার মা-বাপ হচ্ছে জেলা প্রশাসন। সুতরাং এটি যে সব সময় সরকারের সঙ্গে হাত মেলাবে তাতে সন্দেহ নেই। ঋতু বদলায় কিন্তু আইন বদলায় না। মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, মনোনয়নবাণিজ্য বহাল রেখে দেশে বাক্স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার মূল ভাবনায় কাজ করবে এটাই প্রত্যাশিত।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট