হজরত শাহ মখদুম রুপোস (রহ.) মহান ওলি, সুফি ও একজন সাধক ব্যক্তি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষার্ধে এবং চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশের রাজশাহীর বরেন্দ্র ও গৌড় অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছিলেন মহান এ সুফি। মূলত তাঁর মাধ্যমেই এসব অঞ্চল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েছিল। হজরত শাহ মখদুম (রহ.)-এর প্রকৃত নাম আবদুল কুদ্দুস। তবে তিনি শাহ মখদুম রুপোশ নামেই বেশি বিখ্যাত। জন্মসাল নিয়ে মতভেদ থাকলেও প্রামাণিক সূত্রানুযায়ী জানা যায়, ১২১৬ হিজরি ৬১৫ সালের ২ রজব বাগদাদের এক বিখ্যাত সুফি পরিবারে তাঁর জন্ম। তিনি হজরত আলী (রা.)-এর বংশধর ও বড়পীর হজরত আবদুল কাদির জিলানীর নাতি ছিলেন। তাঁর বংশ সম্পর্কে মাজার শরিফের পাশে লেখা অনুযায়ী জানা যায় হজরত আলী (রা.), হজরত হাসান (রা.), সৈয়দ হাসান আল মাসনা, সৈয়দ আবদুল্লাহ আল মাহাজ, সৈয়দ মুসা আল জওন, সৈয়দ আবদুল্লাহ সানী, সৈয়দ মুসা সানি, সৈয়দ দাউদ, সৈয়দ মোহাম্মাদ, সৈয়দ ইয়াহিয়া আল জায়েদ, সৈয়দ আবি আবদুল্লাহ, সৈয়দ আবু সালেহ মুসা জঙ্গি, সৈয়দ আবদুল কাদের জিলানী, সৈয়দ আজাল্লাহ শাহ অতঃপর সৈয়দ আবদুল কুদ্দুস শাহ মখদুম রুপোশ (রহ.)।
হজরত শাহ মখদুমের প্রাথমিক জ্ঞানচর্চার হাতেখড়ি হয় তাঁর পিতা আজাল্লাহ শাহের মাধ্যমে। অতঃপর আবদুল কাদের জিলানী প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়ার পাঠশালায়। তবে তীক্ষè মেধাবী হওয়ায় অল্পতেই কোরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি ভাষা ও ব্যাকরণ, সুফিতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে পাণ্ডিত্য লাভ করেন। পরিবার সিন্ধুতে অবস্থানের সময়ে তখনকার সুফি জালাল উদ্দিন শাহ সুরের সাহচর্য লাভ করে সুফি ধারাবাহিকতার বিভিন্ন শিক্ষাসহ ইসলামি উচ্চতর শিক্ষা, ইজতেহাদি শক্তি অর্জন করেন। তখন তাঁকে ‘মখদুম’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে হজরত শাহ মখদুম (রহ.) গৌড় থেকে বের হয়ে দক্ষিণ দিকে যাত্রা শুরু করে নৌপথে নোয়াখালীতে পৌঁছান। ইসলাম প্রচারের জন্য নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী রেলস্টেশন থেকে প্রায় ১০ মাইল দূরে শ্যামপুর নামক গ্রামে প্রথম বসতি স্থাপন করেন। ১২৮৭ সালে কাঞ্চনপুরে তিনি একটি খানকা নির্মাণ করেন। এ সময় তাঁর অনেক ভক্ত অনুরাগী তৈরি হয়।
নোয়াখালী থেকে নৌপথে শাহ মখদুম রুপোশ পদ্মা নদী থেকে দুই কিলোমিটার দূরে রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় এসে অবতরণ করেন এবং ইসলাম প্রচার শুরু করেন। এ অঞ্চলের সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার ওপর গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন। হজরত শাহ মখদুম রুপোশ রাজশাহী অঞ্চলে প্রায় ৪৪ বছর অবস্থান করেন। এ সময় দেওরাজদের সঙ্গে শাহ মখদুমের তিনবার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধেও দেওরাজদ্বয় তেমন কোনো বীরত্ব দেখাতে পারেননি। আবার পরাজয় ঘটে তাঁদের। ছয়জন রাজকুমারসহ দুজন রাজ-ভ্রাতা বন্দি হন। শাহ মখদুম (রহ.) তাঁদের হত্যা না করে মুক্ত করে দেন এবং আহত রাজকুমারদের নিজের হাতে সেবা করে সুস্থ করেন। শাহ মখদুমের এমন মহানুভবতা দেখে দেওরাজদ্বয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। স্থানীয়দের মুখে শোনা যায়, হজরত শাহ মখদুম রুপোস (রহ.) কুমিরের পিঠে চড়ে নদী পার হতেন। তাঁর অতিপ্রাকৃত শক্তিতে শুধু কুমির নয়, বনের বাঘও বশ্যতা স্বীকার করত।
অবশেষে হিজরি ৭১৩ সালের রজব মাসের ২৭ তারিখ, অর্থাৎ ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। যদিও কিছু সূত্র ১৩১৩ খ্রিস্টাব্দের সঙ্গে সম্পর্কিত বছরটি উল্লেখ করে, অন্যরা পরামর্শ দেয় যে তিনি ১১৭ বছর বয়সে ১৫৯২ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। ওলি আউলিয়াগণ বিভিন্ন দেশ থেকে এ দেশে এসেছিলেন ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য। তাঁরা নিজেদের সম্পদ, দেশ মাটি এমনকি সিংহাসন রেখে এ উপমহাদেশে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের সুমহান বাণী পৌঁছে দেওয়ার জন্য আগমন করেন।
তাঁরা জনগণের মঙ্গলের জন্য সব ধরনের কাজ করে গেছেন। তেমনি হজরত শাহ মাখদুম রুপোস (রহ.)-এর চরিত্র, অন্যের প্রতি মহানুভবতা ও ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে শত শত মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আসেন। বাংলায় ইসলাম প্রচারে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।
লেখক : ইসলামি গবেষক