দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিদেশে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন এসেছে। আগে বেশির ভাগ সময় বাংলাদেশিরা ভারতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করত। কারণ প্রতিবছরই চিকিৎসা, কেনাকাটা, ভ্রমণসহ নানা কাজে অসংখ্য বাংলাদেশি ভারতে যায়। যার ফলে ক্রেডিট কার্ডে ভারতেই সবচেয়ে বেশি খরচ করত বাংলাদেশিরা।
গত কয়েক মাস দেশের ভেতরে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের হার কমেছে। অন্যদিকে, দেশের বাহিরে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ডে খরচ কিছুটা বেড়েছে। তবে প্রতিবেশী দেশ ভারতে এই খাতে ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। একসময় বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড খরচের তালিকায় শীর্ষে ছিল ভারত, এখন সেই অবস্থান থেকে ছিটকে গিয়ে দেশটি ৬ নম্বরে নেমে এসেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার সবচেয়ে বেশি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর রয়েছে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুর। পর্যটন, চিকিৎসা ও শিক্ষাসহ নানা কারণে এসব দেশে খরচের প্রবণতা বেড়েছে বলে জানা গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈদেশিক ভ্রমণের বিধিনিষেধ এবং ভারতে চিকিৎসা ও কেনাকাটার পরিবর্তে অন্যান্য দেশের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় এই পরিবর্তন ঘটছে।
ক্রেডিট কার্ডে দেশে-বিদেশে লেনদেন সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের এপ্রিলের হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বর্তমানে ৬২টি তফসিলি ব্যাংক ও ৩৫টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে ৫৬টি তফসিলি ব্যাংক ও মাত্র একটি এনবিএফআই গ্রাহকদের জন্য ক্রেডিট কার্ড সেবা প্রদান করে থাকে। যাদের তথ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগ দেশের ক্রেডিট কার্ডের প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
প্রতিবেদনে দেশের অভ্যন্তর ও বিদেশে বাংলাদেশের নাগরিকদের এবং দেশের ভেতরে বিদেশি নাগরিকদের ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশিরা বিদেশে ভ্রমণ ও কেনাকাটায় ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে কিছুটা সংযমী হয়ে উঠছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিলে বিদেশে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশিরা ৪৬৮ কোটি টাকা খরচ করেছেন। এই পরিমাণ আগের মাস ফেব্রুয়ারির তুলনায় ২৯ দশমিক ৪৯ শতাংশ বেশি। মার্চে খরচ ছিল ৩৬১ কোটি টাকা। শুধু মাসিক ভিত্তিতেই নয়, গত বছরের একই মাসের তুলনায় এই খরচের পরিমাণে বড় ধরনের পার্থক্য দেখা গেছে। ২০২৪ সালের এপ্রিলে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ডে বিদেশে খরচ হয়েছিল ৫০৬ কোটি টাকা, যা এ বছরের চেয়ে ১৪৫ কোটি টাকা বেশি।
চলতি বছরের এপ্রিলে ভারতে বাংলাদেশিদের ক্রেডিট কার্ড লেনদেন নেমে এসেছে মাত্র ৩১ কোটি টাকায়, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৬৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ কম।
এর আগে, ২০২৪ সালের এপ্রিলে মাসে ভারতে এই খাতে ব্যয় ছিল ৯৮ কোটি টাকা। বিশ্লেষকদের মতে, ভিসা জটিলতা, সীমান্ত পারাপারে কড়াকড়ি এবং অন্যান্য দেশের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাওয়াই প্রতিবেশী দেশে কার্ডে খরচ কমার প্রধান কারণ। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি ক্রেডিট কার্ডধারীদের লেনদেন উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। এসব দেশে উচ্চশিক্ষা, চিকিৎসা, প্রবাসী সংযোগ চাহিদা বাড়ার ফলে ক্রেডিট কার্ডে খরচও ক্রমেই বাড়ছে।
বর্তমানে বিদেশে ক্রেডিট কার্ডে বাংলাদেশিদের খরচের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এপ্রিলে দেশটিতে খরচ হয়েছে ৬৬ কোটি ৭০ লাখ টাকা, মার্চে খরচ ছিল ৫৭ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং ফেব্রুয়ারিতে ৫২ কোটি ৩০ লাখ কোটি টাকা।
দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা থাইল্যান্ডে খরচ হয়েছে ৪৭ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সিঙ্গাপুর; এপ্রিলে দেশটিতে ৪৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা খরচ করেছে। যুক্তরাজ্যে খরচ ৪৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা এবং মালয়েশিয়ায় খরচ ৪৩ কোটি টাকা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান গণমাধ্যমকে বলেন, ব্যবসা, ব্যক্তিগত প্রয়োজন, সন্তানদের পড়াশোনা বা চিকিৎসা— যে কোনও কারণে আগে বাংলাদেশিরা একটি নির্দিষ্ট দেশের ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। তবে ভিসা জটিলতা থাকায় এখন তাদের খরচ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই অন্যান্য দেশে ক্রেডিট কার্ডের লেনদেন বাড়ছে। এটি একটি স্বাভাবিক পরিবর্তন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিবর্তনের পেছনে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপড়েন একটি বড় কারণ। গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকেই বাংলাদেশিদের জন্য ভারত পর্যটক ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। কবে নাগাদ এই ভিসা চালু হবে সে বিষয়ে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আশ্বাস পাওয়া যায়নি।
শুধু ভিসা নয়, ভারত কিছু পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি বন্ধ করেছে, এমনকি ভারত হয়ে অন্য দেশে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহনেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এই পরিস্থিতির কারণে ভারতের প্রতি নির্ভরতা কমে গিয়ে বাংলাদেশিরা এখন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে ভ্রমণ ও ব্যয় বাড়াচ্ছেন।
সূত্র : ঢাকা পোস্ট।