বহির্বিশ্বের নানামুখী চাপের পাশাপাশি একের পর অভ্যন্তরীণ সমস্যা দেশের রপ্তানি খাতে বড় ধরনের হুমকি তৈরি করেছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত স্থলপথে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষিত শুল্ক নিয়ে এখনো সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেনি সরকার। মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চললেও ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধের প্রকোপ আরও বাড়ছে। বৈশ্বিক অস্থিরতায় ইউরোপের ক্রেতারা সংশয়ে আছেন নতুন অর্ডার নিয়ে। বহির্মুখী এসব চাপের পাশাপাশি রয়েছে অভ্যন্তরীণ সংকট। এনবিআর সংস্কার নিয়ে কর্মকর্তাদের ডাকা শাটডাউনের কারণে কাস্টমস পণ্য ছাড়পত্রের যে জট তৈরি হয়েছে তাতে ক্রেতাদের অর্ডার করা পণ্য সময়মতো সরবরাহ অনিশ্চয়তায় পড়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঘরে-বাইরে চতুর্র্মুখী সংকটে পড়েছে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য। বিকেএমইর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দেশি-বিদেশি নানামুখী চাপে পড়েছে দেশের রপ্তানি বাণিজ্য। বৈশ্বিক অস্থিরতার মধ্যে এমনিতেই সংশয়ে আছেন পশ্চিমা ক্রেতারা। ফলে তারা নতুন অর্ডারের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছেন। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সমস্যা রপ্তানি খাতে চতুর্মুখী সংকট তৈরি করেছে। গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকট, এলসি জটিলতা, ডলারের দাম বৃদ্ধি পুরোনো সমস্যা। এরই মধ্যে এনবিআর নিয়ে প্রশাসনিক সংকটের কারণে রপ্তানি খাতে বড় ক্ষতি হয়েছে। শাটডাউনের কারণে কাস্টমস ক্লিয়ারিংয়ে যে জট তৈরি হয়েছে, তাতে করে ক্রেতাদের অর্ডার অনুযায়ী সময়মতো পণ্য সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তাও তৈরি হয়েছে। রপ্তানি বাণিজ্যে বিভিন্ন দেশের শুল্ক ও অশুল্ক বাধাও বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করেছে।
নিট তৈরি পোশাক রপ্তানি খাতের এই নেতা বলেন, ভারতের দিক থেকে স্থলপথে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি সবচেয়ে বড় অশুল্ক বাধা হয়ে এসেছে দেশের রপ্তানি খাতে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্ক বৃদ্ধির ঘোষণাটি রপ্তানি খাতের ইতিহাসে অন্যতম শুল্ক বাধা। মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা কমতে না কমতে ইউক্রেনে হামলা জোরদার করেছে রাশিয়া। ফলে ইউরোপে পণ্য রপ্তানি নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে। ইউক্রেন নিয়ে হয়তো সরকারের কিছু করার নেই, কিন্তু অন্য সমস্যাগুলো সমাধানে উদ্যোগী হতে পারে সরকার।
ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সেটি যে রপ্তানি খাতকে সংকটে ফেলবে- তা অর্থ মন্ত্রণালয়ও স্বীকার করেছে। বাজেটের সঙ্গে প্রকাশিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃক সাম্প্রতিক শুল্ক আরোপের কারণে রপ্তানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, একই ধরনের শুল্ক অন্যান্য প্রতিযোগী দেশগুলোর জন্য প্রযোজ্য। এ ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনাও চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার পরও আশঙ্কা কাটেনি। সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের রপ্তানি আয়ে ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। সে হিসাবে মোট রপ্তানি আয় ৪৮ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নীতি বিবৃতিতে। দেখা যাচ্ছে অর্থ বিভাগ চলতি অর্থবছরে রপ্তানি আয় ও প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য দেখাচ্ছে, তা সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরের প্রাক্কলিত লক্ষ্যের তুলনায় অনেক কম। সদ্যসমাপ্ত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৫৭.৫ বিলিয়ন ডলার নির্ধারণ করা হয়েছিল। পণ্য ও সেবা উভয় খাতেই প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১২ দশমিক ৪ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, শুধু এনবিআর আন্দোলনের কারণে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতে প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ভারতের স্থলপথে রপ্তানি পণ্যে নিষেধাজ্ঞার ফলে সব মিলিয়ে আরও প্রায় ৬৫ কোটি মার্কিন ডলারের রপ্তানি ক্ষতির মুখে পড়বে। এনবিআরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৫৯ কোটি মার্কিন ডলার। এরমধ্যে প্রথম দফায় গত ১৭ মে ভারত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল, তাতে প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ গত বুধবার আরও ৯ পণ্যে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে বছরে আরও ১৫ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। সবমিলিয়ে শুধু ভারতেই ৬৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এর বাইরে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে শুল্ক সমঝোতা না হলে বড় ধরনের সংকটে পড়বে দেশের রপ্তানি খাত।
বিকেএমইএর সাবেক নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম আহসান বলেন, রপ্তানি খাত নিয়ে ভারতের সঙ্গে জটিলতার শুরু প্রথমত আমাদের দিক থেকেই তৈরি হয়েছে। এরপর তারা একের পর এক নিষেধাজ্ঞা বাড়িয়ে যাচ্ছে। ভারতের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার ফলে যে ক্ষতি হবে বড় শিল্প তা মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেলেও ছোট ছোট রপ্তানিমুখী শিল্প বিপর্যয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করেন তিনি। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের আরোপিত শুল্ক নিয়ে সমঝোতা না হলে, ছোট-বড় সব ধরনের রপ্তানিমুখী শিল্প বড় ধরনের সংকটে পড়বে।