বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তির শুরু থেকেই আদানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ক্রয় নিয়ে নানা সমালোচনা ছিল। ভারতের ঝাড়খণ্ডের গড্ডায় নির্মিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের শুরুর দুই বছর পরও বিদ্যুতের পাওনা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও আদানি পাওয়ারের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ থেকে বারবার বলার পরও এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জ্বালানি, কয়লার দাম। এতে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি অমান্য করেই মনগড়া বিল বানিয়ে তা বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)-কে পাঠাচ্ছে আদানি পাওয়ার। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আদানি ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে এই চুক্তি করেছে। যে অর্থ দিয়ে আদানির কাছ থেকে আমরা বিদ্যুৎ নেব তার অর্ধেক পয়সায় আমরা নিজেরাই কয়লা কিনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় একটি ক্রিয়াশীল ও সুবিধাবাদী চক্র এই চুক্তিটি তৈরির সময় সক্রিয় ভূমিকায় ছিল। চক্রটি দেশের স্বার্থের ক্ষতি করে আদানির স্বার্থ দেখেছে। এই চক্রটিকে চিহ্নিত করে তাদের জ্বালানি অপরাধী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করতে হবে। আর তা না হলে দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে না।
জনসাধারণের কাছ থেকে আদানি বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিভিন্ন ধারাগুলো গোপন রেখে চুক্তি হলেও বিতর্কিত এই চুক্তিটি হয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তত্ত্বাবধানে। সে সময়কার বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং চুক্তির সময়কালীন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সচিব আহমদ কায়কাউস চক্র এই চুক্তি তৈরির সময় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
যেভাবে অনিয়মের শুরু : এই প্রকল্পের কাজ শুরুর সময় ঝাড়খ ছিল বিজেপি শাসিত। সে সময়কার মুখ্যমন্ত্রী রঘুবর দাসের কাছে আদানি গ্রুপ প্রকল্পের জন্য গড্ডা জেলায় ৬টি গ্রামের প্রায় হাজার একর জমি চায়। আর এই জমি নিতে আদানি পেশিশক্তির ব্যবহার, অকারণে মানুষকে গ্রেপ্তার, গরিব মানুষের জীবিকা কেড়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটায়। যা সে সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জমিকে ভারত সরকার বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করলে প্রকল্পটির জন্য আদানি পাওয়ার শুল্ক-কর ছাড় পায়। এতে এ প্রকল্পে বাংলাদেশের ক্যাপাসিটি চার্জ ও কয়লা আমদানি ব্যয় কমে যাওয়ার কথা কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং কর ছাড়ের বিষয়টি গোপন রেখে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতারণা করেছে আদানি গ্রুপ। অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক মনিটরিং গ্রুপ আদানি ওয়াচের এক নিবন্ধে উল্লেখ করা হয় এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির মতো বিতর্কিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভারতের ইতিহাসে সম্ভবত একটিও নেই। এর নির্মাণের প্রতিটি পর্যায়ে দেশটির প্রচলিত আইনকানুন ও নিয়মনীতিতে বুড়ো আঙুল দেখানো হয়েছে। সব ধরনের সরকারি সুযোগসুবিধা আদানিকে দেওয়া হয়েছে।
যেভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে দেশের স্বার্থ : বাংলাদেশ আদানির সঙ্গে ২০১৭ সালে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করলেও জনসম্মুখে চুক্তির ধারাগুলো প্রকাশ ছাড়াই ২০২৩ সাল থেকে বাংলাদেশ আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশে সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করত কিন্তু শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর অল্প সময়েই ভারত সরকার আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিদ্যুৎ বিক্রির অনুমতি দেয়। আবার আদানি পাওয়ার বাংলাদেশের সঙ্গে করা বিদ্যুৎ চুক্তির ধারা না মেনেই আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের দাম, কয়লার দাহ্য ক্ষমতামহ বিভিন্ন বিষয়কে সামনে রেখে নিজেদের মনমতো বাংলাদেশে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করছে। এতে এখন পর্যন্ত পিডিবি-এর হিসাবে যেখানে আদানির পাওনা ৫০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ। কিন্ত আদানি কর্তৃপক্ষ দাবি করছে তারা পিডিবির থেকে ৯০০ মিলিয়ন ডলার পায়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আদানির পাওনা পরিশোধের উদ্যোগ গ্রহণের পরও বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার মতো হুমকি দিয়েছে আদানি কর্তৃপক্ষ। আবার আাদানি গ্রুপের কাছ থেকে যে বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে তার দামও বাংলাদেশে আমদানিকৃত অন্য কেন্দ্রগুলো থেকে বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের আদানি থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয় গড়ে ১৪ টাকার বেশি দামে। অন্যদিকে ভারতের আরও ৪টি উৎস থেকে যে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আমদানি হয় তার গড় দাম ছিল ৮ টাকার নিচে।
অনৈতিকভাবে অর্থ আদায়ে যেভাবে চাপ দিচ্ছে আদানি : পায়রা ও রামপালের চেয়ে প্রতি টন কয়লার দাম ১৫ থেকে ২০ ডলার বাড়তি চায় আদানি। পিডিবির সঙ্গে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তিতে উল্লেখ করা সূত্রের সুযোগ নিয়ে এভাবে বাড়তি দাম চাইছে আদানি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আদানির সঙ্গে পিডিবির চুক্তি পর্যালোচনার জন্য সরকারের গঠিত একটি কমিটি কাজ শুরু করে। সেই কমিটি সূত্রে জানা যায়, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আদানির সঙ্গে করা পিডিবির চুক্তিটি ‘অসম’। চুক্তিতে আদানিকে বেশ কিছু সুবিধা দেওয়া হয়েছে। চুক্তিতে উল্লেখ করা কয়লার দামের সূত্র দেখে মনে হয়েছে যে বিদ্যুৎ নয়, মূলত কয়লা বিক্রি করেই ব্যবসা করতে চেয়েছে আদানি।
পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আদানির পাওনা বিষয়ে ওরা একটা হিসাব করছে আর আমরা একটা বলছি। এ বিষয়ে আলোচনা চলছে, এটি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনো সমাধানে যেতে পারব না। এটি নিয়ে এরই মধ্যে বৈঠক হয়েছে। এর ধারাবাহিক কার্যক্রম চলবে। আমরা এখন যেভাবে আদানির পাওনা দিচ্ছি সেটা চালিয়ে যাব। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর ঠিক হবে কোনটি নির্ধারণ হবে। কয়লার দাম নিয়ে যে আলোচনা হয়েছে তা নিয়ে আদানি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো ইতিবাচক সাড়া পাইনি।