কৌশলগত সংস্কার ও নতুন বাজারে প্রবেশ নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত ২০২৯ সালের মধ্যে বার্ষিক রপ্তানি আয় ৯৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাতে পারে। এ লক্ষ্য অর্জনে বছরে গড়ে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হবে। এজন্য বাণিজ্য, শিল্প ও আর্থিক খাতে সমন্বিত সংস্কার করতে হবে।
বিশ্বব্যাংক, ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এবং মাল্টিলেটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সির ‘কান্ট্রি প্রাইভেট সেক্টর ডায়াগনস্টিক’ শীর্ষক এক যৌথ প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে।
গতকাল ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। গত অর্থবছরে জুলাই থেকে মে পর্যন্ত মোট ৩৯ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে।
প্রতিবেদনে দেশের চারটি প্রধান খাতকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নের চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। খাতগুলো হলো; পরিবেশবান্ধব পোশাক খাত; মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য আবাসন; স্থানীয়ভাবে রং ও রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন এবং ডিজিটাল আর্থিক সেবা সম্প্রসারণ। বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এসব খাতে সুনির্দিষ্ট বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বহু গুণে বাড়ানো সম্ভব। তৈরি পোশাক, রং ও রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ও নীতিগত সহায়তা প্রদান করা হলে আনুমানিক ৬ লাখ ৬৪ হাজার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। ডিজিটাল আর্থিক খাতেও সংস্কার আনা হলে অতিরিক্ত ৪ লাখ ৬০ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে ৩ লাখ ৬০ হাজার অনানুষ্ঠানিক চাকরি আনুষ্ঠানিক খাতে অন্তর্ভুক্ত হবে বলে জানানো হয়েছে। আবাসন খাতেও বড় ধরনের বিনিয়োগ সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিবেদন অনুসারে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন প্রকল্পে ২০০ কোটি ডলারের বেসরকারি বিনিয়োগ আকর্ষণ সম্ভব। প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ব্যবসা পরিবেশে বিদ্যুৎঘাটতি, অর্থায়নে সীমাবদ্ধতা, দুর্নীতি, অপ্রাতিষ্ঠানিকতা এবং উচ্চ করহার এখনো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। অনুষ্ঠানে লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, বিনিয়োগকারীদের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় হলো নীতির অস্থিরতা, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি। বিশ্বব্যাংকের সিনিয়র অপারেশনস অফিসার সুহাইল কাসিম বলেন, ম্যানমেইড ফাইবার ভিত্তিক কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক, পানি ও বর্জ্যব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা এবং প্রযুক্তিতে বিনিয়োগঘাটতি এ খাতের সবুজ রূপান্তরের পথে বড় বাধা। তিনি আরও বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ইউরোপের বাজারে প্রবেশাধিকার বজায় রাখতে হলে শ্রম আইনে সংস্কার এবং ইউরোপীয় নতুন পরিবেশবান্ধব নীতিমালা (যেমন : ইকোডিজাইন ফর সাসটেইনেবল ফর সাসটেইনেবল প্রডাক্টস রেগুলেশন) মেনে চলতে হবে।
প্রতিবেদন অনুসারে, বাজার কারসাজির নিয়ন্ত্রণে কিছু জরুরি সংস্কার প্রয়োজন। যেমন- পিইটি বোতল ও ফ্লেক রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা বাতিল; সৌর ইনভার্টার ও প্যানেলের ওপর শুল্ক সমন্বয়; পোশাক খাতে পানি দক্ষতাসংক্রান্ত সার্টিফিকেশন চালু; রং ও রাসায়নিক খাতে আমদানিকৃত কাঁচামালের শুল্ক শ্রেণিবিন্যাসে স্বচ্ছতা; কাস্টমস ও বন্ডেড ওয়্যারহাউজ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন; ভূমি নিবন্ধন ও আবাসন অনুমোদন প্রক্রিয়ার ডিজিটালাইজেশন; ডিজিটাল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস খাতে হোলসেল লেনদেন ও স্ট্রাকচার্ড ফাইন্যান্সের পথ সুগম করা।
বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের নতুন কান্ট্রি ডিরেক্টর জাঁ পেসমে, আইএফসির কান্ট্রি ম্যানেজার মার্টিন হোল্টম্যান এবং অন্য কর্মকর্তারাও অনুষ্ঠানে এসব দিক তুলে ধরেন।
বিশ্বব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মতে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা অত্যন্ত উজ্জ্বল। তবে তা পুরোপুরি বাস্তবায়নের জন্য দরকার নীতিগত স্পষ্টতা, ডিজিটাল রূপান্তর এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বিনিয়োগ পরিবেশ।