মুস্তফা কামাল ক্রীড়াপ্রেমী। বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। বিপিএলে ‘কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানস’ নামে একটি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানা কিনেছিল কামাল পরিবার। সাকিব আল হাসানের মতো ক্রিকেট অলরাউন্ডারদের পছন্দ করেন লোটাস কামাল। নিজের ব্যক্তিজীবনেও তিনি অলরাউন্ডার। অবশ্য সেটি দুর্নীতিতে। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি থেকে আদম ব্যবসা, টেন্ডারের কমিশন থেকে কমিটি বাণিজ্য-দুর্নীতির সব শাখায় অবাধ বিচরণ লোটাস কামালের। দুর্নীতিই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। যখন যে কাজ করেছেন সেখানেই জড়িয়েছেন দুর্নীতিতে। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, পাঁচবার এমপি ছিলেন কুমিল্লা-১০ আসনের। সামলেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। তাঁর হাতেই দেশের অর্থনীতি বলা চলে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে! অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে বলেছিলেন, ‘খেলাপি ঋণ আর একটাও বাড়তে দেওয়া হবে না।’ কিন্তু তাঁর সময়টা বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে। ব্যাংকিং সেক্টরে লুটপাটের প্রধান কুশীলব লোটাস কামাল। এস আলমের হাতে নয়টি ব্যাংক তুলে দিয়ে তিনি অর্থনীতিতে লুটতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ গঠন, এমডি নিয়োগেও ঘুষ খেতেন সাবেক এই অর্থমন্ত্রী। নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে সরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছেন। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে ঋণ প্রদানে বাধ্য করেছেন সরকারি ব্যাংকগুলোকে। ঘুষের বিনিময়ে ঋণ প্রদান কার্যক্রমের জনক ছিলেন আ হ ম মুস্তফা কামাল। অতীতে কোনো অর্থমন্ত্রী এভাবে ব্যাংক ঋণ প্রদানে অবৈধ প্রভাব খাটাননি। দেশের আর্থিক খাতের অভিভাবক যদি এভাবে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তাহলে ব্যাংকিং খাতের যা হওয়ার, ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তা-ই হয়েছে। ব্যাংকিং সেক্টরে সৃষ্টি হয়েছিল লুটতন্ত্র।
লোটাস কামাল দুর্নীতি করেননি এমন কোনো সেক্টর নেই। সংগঠন এবং এলাকায়ও তিনি করেছেন দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্য।
এস আলম গ্রুপের সঙ্গে গভীর সখ্য রেখে নিজের ও স্বজনের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকা লোপাট এবং পাচার করেছেন। সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) কে এম সিংহ রতনকে কামাল ‘ছায়ামন্ত্রী’ বানিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতেন আর্থিক ও ব্যাংক খাত। পেতেন তদবির, নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলি বাণিজ্যের কমিশন। ভাইয়ের মাধ্যমে কবজায় রেখেছেন দলীয় পদপদবি। টেন্ডার, টিআর ও কাবিখা থেকে হাতিয়েছেন অর্থ।
১৯৯৪ সালে তৎকালীন কুমিল্লা-৯ আসনের এমপি অধ্যক্ষ আবুল কালাম মজুমদার মারা গেলে ভাগ্য খোলে মুস্তফা কামালের। রাজনীতিতে এসে ১৯৯৬ সালে নৌকার টিকিটে প্রথমবার এমপি হন। ২০০১ সালে পরাজিত হলেও, ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তাঁর দল আওয়ামী লীগের মতোই বিনা ভোটে এমপি হয়েছেন তিনি। এর মধ্যে ২০১৪ সালে পরিকল্পনা এবং ২০১৯ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে বিসিবি সভাপতি ও ২০১৪ সালে আইসিসির সভাপতি নির্বাচিত হন।
নির্বাচন কমিশনে দেওয়া হলফনামায় কামাল নিজের চেয়ে স্ত্রী কাশমেরি কামালের সম্পদ বহুগুণ বেশি দেখিয়েছেন। গত ৭ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগে জমা দেওয়া হলফনামায় কামালের অস্থাবর সম্পদ ৪১ কোটি ৯০ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। কিন্তু স্ত্রীর দেখিয়েছেন ৬২ কোটি ২৭ লাখ ১৯ হাজার টাকা। নিজের স্থাবর সম্পদের আর্থিক মূল্য ২ কোটি ৩০ লাখ হলেও স্ত্রীর রয়েছে ৫ কোটি ৪২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। স্ত্রী, দুই মেয়ে ও পাঁচ নাতিনাতনিকে দান করায় সম্পদ কমেছে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। এর মধ্যে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির উদ্যোক্তা শেয়ারের ২ কোটি ৪ লাখ ৫ হাজার টাকা মেয়ে নাফিসা কামালকে এবং স্ত্রী, মেয়ে ও পাঁচ নাতি-নাতনিকে দিয়েছেন ৩১ কোটি টাকার সম্পত্তি।
কিন্তু হলফনামায় উল্লেখ করা কামালের সম্পদের সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। দেশেই লোটাস কামালের সম্পদের পরিমাণ হাজার কোটি টাকা। শুধু শেয়ার কেলেঙ্কারি আর অর্থ পাচার নয়, দুর্নীতিতেও মুস্তফা কামাল ছিলেন চ্যাম্পিয়ন। নিজ এলাকায় প্রকল্প বাগিয়ে নেওয়া এবং তার মাধ্যমে লুটপাট ছিল লোটাস কামালের দুর্নীতির পছন্দের কৌশল।
পরিকল্পনামন্ত্রী থাকাকালে শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন প্রকল্পে তিনি শর্ত জুড়ে দেন-কুমিল্লা জেলাকে অন্তর্ভুক্ত করলেই কেবল অনুমোদন দেবেন। এরই অংশ হিসেবে ২০১৮ সালে বাড়ির পাশে সাড়ে ১০ একর জমিতে হয় শেখ কামাল আইটি সেন্টার। কুমিল্লাসহ সাত জেলায় প্রায় ৫৩৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ের এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। স্থানীয় সূত্র জানান, গ্রামীণ এলাকায় লোটাস কামালের ইচ্ছাধীন এ প্রকল্প কোনো কাজেই আসেনি। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণ থেকে ইট-বালু-রডসহ সব ধরনের সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে তাঁরই গড়া সিন্ডিকেট। অবৈধভাবে নিজের পছন্দের লোকজনকে কাজ দিয়েছেন। বিনিময়ে তিনি পেয়েছেন মোটা অঙ্কের কমিশন। একটি মেগা প্রকল্প থাকার পরও কামাল ২০২৩ সালের ২ সেপ্টেম্বর তৎকালীন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে দিয়ে ৭ দশমিক ৮৮ একর জমিতে প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে করিয়ে নেন নলেজ পার্ক। জমি অধিগ্রহণ শেষে সীমানা দেয়াল ছাড়া কিছুই হয়নি পার্কের।
জানা যায়, ২০১৩ থেকে গত জুলাই পর্যন্ত কুমিল্লা সদর দক্ষিণ, নাঙ্গলকোট ও আদর্শ সদর উপজেলায় মোট ৪২টি খাল খননের জন্য ১৯ কোটি ৬৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়। কামালের নির্দেশে তাঁর সিন্ডিকেট কোনো কাজ না করেই পুরো টাকা লোপাট করেছে এমন অভিযোগ এনে গত ১৪ অক্টোবর আদালতে মামলা করেছেন সদর দক্ষিণ জেলা কৃষক সমবায় ঐক্য পরিষদের পক্ষে সংগঠনের সভাপতি মুহম্মদ আখতার হোসাইন।
২০০৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন লোটাস কামাল। প্রথমে দীর্ঘ ১০ বছর আহ্বায়ক এবং পরে দুই দফায় সভাপতির পদ দখলে রেখেছেন। কাগজে-কলমে মুস্তফা কামাল এমপি হলেও নির্বাচনি এলাকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছেন ছোট ভাই, সদর দক্ষিণ উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার। দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাদ দিয়ে তাঁকে ২০০৯, ২০১৪ ও ২০১৯ সালে প্রভাব খাটিয়ে চেয়ারম্যান করেন তিনি।
উপজেলা চেয়ারম্যান সারোয়ার তাঁর গাড়িচালক আবদুর রাজ্জাক ও বারপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম আহমেদের সহায়তায় লালমাই পাহাড়ে মাটিকাটা সিন্ডিকেট থেকে চাঁদা তুলেছেন। ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে টিআর-কাবিখার টাকা লুটেছেন। জুনের প্রথম সপ্তাহে সারোয়ার কানাডা গিয়ে আর ফেরেননি। অভিযোগ রয়েছে, কামালের সিন্ডিকেট ম্যানেজ না করে কেউ ইউপি সদস্যও হতে পারেননি। জনপ্রতি একজন চেয়ারম্যানকে ৩০-৪০ লাখ এবং ইউপি সদস্যকে ৫ লাখ টাকা দিতে হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে নিয়েছেন ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। ২০১৭ সালে নবগঠিত লালমাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি করেন বড় ভাই আবদুল হামিদকে। আর সাধারণ সম্পাদক করেন এপিএস কে এম সিংহ রতনকে। গত বছর হামিদের ছেলে, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কামরুল হাসান ওরফে শাহীনকে কেন্দ্র দখলের মাধ্যমে লালমাই উপজেলা চেয়ারম্যান করেছেন। রতনকে নাঙ্গলকোট এলাকার দায়িত্ব দেন কামাল। স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর অসুস্থতার অজুহাতে অর্থমন্ত্রী এলাকায় আসা বন্ধ করে দেন। তখন রতনই ছিলেন ছায়ামন্ত্রী। দলীয় পদপদবি ছাড়াও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, সরকারি চাকরি ও বদলির নামে ঘুষ বাণিজ্য করেছেন রতন। তাঁরও দেশে-বিদেশে অঢেল সম্পদ রয়েছে। রতন ছাড়াও একান্ত সচিব (পিএস) মোহাম্মদ ফেরদৌস আলম ঢাকায় লোটাস কামালের নির্দেশে ব্যাংক ও আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানা গেছে। ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর একনেক সভায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) ক্যাম্পাস সম্প্রসারণসহ অধিকতর উন্নয়নে ১ হাজার ৬৫৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা অনুমোদন দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, কামাল পরিকল্পনামন্ত্রী থাকায় ওই প্রকল্প পাস হওয়ার আগেই তাঁর ভাই গোলাম সারোয়ার দলীয় নেতা-কর্মীর মাধ্যমে পাহাড়-টিলা, জঙ্গলঘেরা জমি নামমাত্র দামে কিনে পরে অধিগ্রহণের সময় চড়া দামে বিক্রি করেন। প্রায় ৪৭১ কোটি ১১ লাখ ২২ হাজার টাকায় ১৯৯ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। জানা যায়, মন্ত্রীর ভাইয়ের সিন্ডিকেট এ প্রকল্প থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা লোপাট করেছে। এভাবেই সর্বব্যাপী দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলেন লোটাস কামাল। তাঁর ব্যবসা, রাজনীতি সবকিছুর লক্ষ্য একটাই-অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা। সেদিক থেকে নিশ্চয়ই তিনি সফল ‘অলরাউন্ডার’।