হিজরি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। সৃষ্টির সূচনা থেকে পবিত্র এ মাসের ১০ তারিখ নানা স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়। ১০ মহররম মহান রব্বুল আলামিন প্রতিপালক হিসেবে আরশে সমাসীন হন, তাই এ দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যধিক। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের পালনকর্তা আল্লাহ, যিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিন ছয় দিনে, তারপর তিনি সমাসীন হন আরশে, তিনি পরিচালনা করেন প্রতিটি কাজ।’ (সুরা ইউনুস ১০ : আয়াত ৩)। পবিত্র আশুরার দিনটি মহান স্রষ্টার অভিষেকের দিন হিসেবে অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। রসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা হজরত আদম (আ.)-কে শুক্রবার আসরের পর সৃষ্টি করেন। অতঃপর তিনি আরশে সমাসীন হন (বস্তুত দিনটি ছিল, মহররম মাসের দশম তারিখ পবিত্র আশুরার দিন)।’ (মেশকাত শরিফ : পৃষ্ঠা ৫১০)।
মহান আল্লাহ মহররম মাসের ১০ তারিখ পবিত্র আশুরার দিবসে আরশে সমাসীন হন। বড়পীর হজরত আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) বলেন, ‘আল্লাহ রব্বুল আলামিন আশুরার দিনে আরশে সমাসীন হয়েছেন। বিশ্বজাহান ধ্বংসও হবে এ দিনে। সর্বপ্রথম বৃষ্টি ও আল্লাহর রহমত দুনিয়াতে বর্ষিত হয় এ আশুরার দিনেই।’ (গুনিয়াতুত তালিবিন : পৃষ্ঠা ৩২৬)। মহান আল্লাহ নিজেই ১০ তারিখ তথা ১০ সংখ্যাটির কসম করে পবিত্র কোরআনে আয়াত নাজিল করেছেন। আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘কসম ফজরের সময়ের, আর কসম ১০ রাতের অর্থাৎ মহররমের ১০ তারিখের।’ (সুরা আল ফাজর ৮৯ : আয়াত ১-২)। এখানে ১০ তারিখকে ১০ রাত বলা হয়েছে এজন্য যে, আরবি তারিখ গণনা করা হয় রাতের শুরুর দ্বারা।
আশুরার দিনটি যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে উদ্যাপন করা সবার জন্য অপরিহার্য। এতে স্রষ্টার অবারিত রহমত লাভ করা সম্ভব হবে। এ দিনটি কুল কায়েনাতের সবার জন্য অবারিত রহমত পাওয়ার দিন। আশুরার দিনে মানবজাতির আদি পিতা হজরত আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয় এবং পরবর্তীতে এ দিনেই তাঁকে প্রতিনিধি করে দুনিয়াতে পাঠানো হয়। এ ছাড়া আশুরার পবিত্র দিবসে আদম (আ.)-এর অপরাধ ক্ষমা করা হয়। এই দিনে মহাপ্লাবনকালে হজরত নুহ (আ.)-এর নৌকা তাঁর অনুসারীদের নিয়ে জুদি পাহাড়ের পাদদেশে এসে থেমে যায়; হজরত ইব্রাহিম (আ.) ভূমিষ্ঠ হন এবং এদিনে তিনি নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে উদ্ধার পান। পবিত্র আশুরার দিবসে হজরত আইয়ুব (আ.) রোগমুক্ত হন; হজরত দাউদ (আ.) মহান আল্লাহর কাছ থেকে ক্ষমা পান; হজরত সোলায়মান (আ.) তাঁর হারানো রাজত্ব পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন; হজরত ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান; হজরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর হারানো পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.)-কে ৪০ বছর পর ফিরে পান। পবিত্র আশুরার দিনে ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আছিয়া শিশু মুসা (আ.)-কে গ্রহণ করেন; আবার এ দিনে হজরত মুসা (আ.) স্বীয় অনুসারীদের নিয়ে লোহিত সাগর অতিক্রম করেন, অন্যদিকে খোদাদ্রোহী ফেরাউন সদলবলে লোহিত সাগরে ডুবে মারা যান। এ দিনে হজরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং চতুর্থ আসমানে উত্থিত হন। আশুরার বরকতময় দিনের উসিলায় বহু নবী-রসুল আপদ-বিপদ থেকে রক্ষা পান। আশুরা হলো বান্দাদের জন্য আল্লাহর কাছে চাওয়া ও পাওয়ার দিন। পবিত্র আশুরার দিনে ২ হাজার নবী ও রসুলের শুভ জন্ম হয়।
রসুল (সা.) বলেন, ‘আশুরার দিনটি এমন একটি দিন যে, সব নবী-রসুল এ দিনে রোজা রাখতেন। সুতরাং তোমরাও এ দিনে রোজা রাখো।’ (তাফসিরে দুররে মানছুর-৩০ নম্বর খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯৯)। তিনি বলেন, ‘রমজান মাস এবং আশুরার দিন ছাড়া রোজা রাখার ব্যাপারে অন্য কোনোদিন বেশি ফজিলতের দাবি রাখে না। (অর্থাৎ অন্য সব দিন থেকে রমজান মাস ও আশুরার রোজার বেশি ফজিলত রয়েছে।’ (তাফসিরে দুররে মানছুর-৩০ নম্বর খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯৯)। আল্লাহর রসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা আশুরার রোজা রাখো। ইহুদিদের বিপরীত কাজ করো। তোমরা আশুরার রোজার সঙ্গে আগের দিন অথবা পরের দিন আরেকটি রোজা রাখো।’ (তাফসিরে দুররে মানছুর-৩০ নম্বর খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৯৯)। আশুরার দিনের ফজিলত সম্পর্কে রসুল (সা.) বলেন, ‘যারা আশুরার দিন চোখে সুরমা বা কাজল লাগাবে, তারা কখনো চোখ ওঠা রোগে আক্রান্ত হবে না।’ (তাফসিরে দুররে মানছুর-৩০ নম্বর খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫০০)। পবিত্র আশুরার দিনটি বিশ্ব মুসলিমের কাছে সবচেয়ে স্মরণীয় ও হৃদয়বিদারক কারণ এ দিনেই সাইয়্যেদুল আম্বিয়া হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, আমিরুল মুমিনিন হজরত আলী (রা.) ও খাতুনে জান্নাত হজরত ফাতেমা (রা.)-এর হৃদয়ের ধন, মোহাম্মদি ইসলামের অকুতোভয় বীরসেনানী ইমাম হোসাইন (রা.) মাত্র ৭২ জন সহযোগী নিয়ে দুরাচার ইয়াজিদের ২২ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে জিহাদ করে শাহাদাতবরণের মাধ্যমে সত্য ও ন্যায়ের জন্য আপসহীন সংগ্রাম করার এক মহান আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। তাঁর এই সুমহান ত্যাগ রসুল প্রেমিকরা গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করে থাকে।
লেখক : গবেষক, সাবেক সহযোগী অধ্যাপক, পিইউবি