ব্যাংকঋণের উচ্চ সুদের হার, ডলারের দাম, গ্যাসের দাম এবং কর্মীদের বেতন বাড়ানোয় খরচ বেড়েছে। এলসি খুলতে সমস্যা, ঋণের জোগান কম, গ্যাসসংকটে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি ও পণ্যের দাম বাড়ায় ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতাও কমে গেছে। ফলে পণ্যের বিক্রি কমেছে।
দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না। এসব কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ দাবি করছে, এমন পরিস্থিতিতে তাদের ৬০০ কারখানা এখন খেলাপি হয়ে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। তাই তারা ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা ছয় মাস করার পক্ষে।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খানের নেতৃত্বে বিজিএমইএর একটি প্রতিনিধিদল গতকাল বুধবার প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করে। এ সময় সংগঠনের নেতারা পোশাকশিল্পে বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানানোর পাশাপাশি একগুচ্ছ দাবি তুলে ধরেন।
আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ে আয়োজিত এই বৈঠকে বিজিএমইএ প্রতিনিধিদলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন সহসভাপতি (অর্থ) মিজানুর রহমান, সহসভাপতি মো. শিহাব উদ্দোজা চৌধুরী এবং সদস্য মো. কামাল উদ্দিন।
ড. আনিসুজ্জামানের সঙ্গে বৈঠকে বিজিএমইএ নেতারা তৈরি পোশাক শিল্পের বর্তমান চ্যালেঞ্জসমূহ, ব্যাংকসংক্রান্ত সমস্যাবলি, এনবিআরসংক্রান্ত বিষয়, শিল্পে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য করণীয়, চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা উন্নয়ন, ট্রেড লাইসেন্সসহ ইআরসি, আইআরসি এবং লাইসেন্স নবায়নে জটিলতা দূরীকরণ ও মেয়াদ অন্তত পাঁচ বছর করা, রাজউক কর্তৃক ড্যাপের আওতায় এর আগে নির্মিত কারখানাগুলোর হয়রানির শিকার হওয়াসহ আরো কিছু বিষয়ে সমাধান চান সরকারের কাছে।
এ ছাড়া বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ শ্রেণীকরণ নীতিমালা ব্যবসাবান্ধব করতে বিশেষ জোর দেওয়া হয়। বৈঠকে বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা ৯ মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করা হয়েছে। বিদ্যমান সংকটের সময়ে আর্থিক কারণে উদ্যোক্তারা এই সময়ের মধ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন না। ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা ছয় মাসে উন্নীত করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে মাহমুদ হাসান খান বলেন, এটি করা হলে ছয় শতাধিক পোশাক কারখানা ক্লাসিফায়েড ঋণ থেকে রক্ষা পাবে।
তিনি আরো উল্লেখ করেন, বিশেষ নগদ সহায়তা ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.৩০ শতাংশ এবং বিকল্প নগদ সহায়তা ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১.৫ শতাংশ করা হয়েছে। নগদ সহায়তার হার ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনা পোশাকশিল্পের জন্য সহায়ক ও সময়োপযোগী নয় বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। শিল্প ও দেশের স্বার্থে নগদ সহায়তা বিষয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার অনুরোধ জানান তিনি। বৈঠকে বিজিএমইএ নেতারা পোশাক শিল্পে ১ শতাংশ হারে কর্তনকৃত উৎস করকে বছর শেষে চূড়ান্ত করদায় হিসেবে নিষ্পত্তি করার সুপারিশ করেন।
তিনি বলেন, প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট খাতে পুনরর্থায়ন স্কিমটি বর্তমানে বন্ধ আছে। তাঁরা চান এই স্কিম আবার চালু করে ২০৩০ সাল পর্যন্ত কার্যকর করা হোক। এটি করা হলে উদ্যোক্তাদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল জোগানে সহায়তা করবে। একই সঙ্গে তাঁরা উদ্যোক্তাদের সহায়তায় রপ্তানির বিপরীতে একটি ফোর্সড তহবিল গঠনেরও প্রস্তাব দেন, যেখান থেকে সংকটের সময়ে সংশ্লিষ্ট কারখানা শ্রমিকদের বেতন প্রদান ও অন্যান্য সমস্যা সমাধান করতে পারবেন।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান আরো বলেন, পোশাকশিল্পের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে কাস্টমসসংক্রান্ত প্রক্রিয়াগুলোর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে এবং এসংক্রান্ত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে গিয়ে শিল্পের উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, ব্যাবসায়িক প্রক্রিয়াগুলোতেও অপ্রয়োজনীয় বিলম্ব হয়। তিনি বলেন, বর্তমান বিশ্ব বানিজ্য প্রেক্ষাপটে লিড টাইম কমিয়ে শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে কাস্টমস প্রক্রিয়াগুলোকে সহজীকরণ, দ্রুততর ও হয়রানিমুক্ত করা অপরিহার্য।
বৈঠকে বিজিএমইএ নেতারা চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বৃদ্ধিরও অনুরোধ জানান। এ ছাড়া বৈঠকে পোশাকশিল্পসহ বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় তীব্র গ্যাসসংকটের প্রভাব পড়েছে বলে উদ্বেগ জানানো হয়। বিজিএমইএ সভাপতি গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য ভোলায় আবিষ্কৃত বিপুল মজুদের নতুন গ্যাসকূপগুলো থেকে অবিলম্বে গ্যাস উত্তোলন করে তা জাতীয় গ্রিডে নেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শিল্পে গ্যাসের চাহিদা পূরণে এলএনজি আমদানি বৃদ্ধি নিয়েও আলোচনা করা হয়।
বিজিএমইএ নেতারা মুন্সীগঞ্জে বন্ধ হয়ে যাওয়া গার্মেন্টপল্লী স্থাপন কার্যক্রম পুনরায় শুরু করা এবং চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলোর জন্য একটি সমন্বিত শিল্পাঞ্চল গড়ে তুলতে জমি বরাদ্দ দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীর সহযোগিতা কামনা করেন।
ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বিজিএমইএ প্রতিনিধিদলের বক্তব্য শুনে বলেন, সরকার পোশাকশিল্প সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে অবগত আছে এবং এই শিল্পকে সম্ভাব্য সব সহযোগিতা প্রদান করে যাবে।