প্রতি আদমশুমারির পর সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণে একটি সাংবিধানিক বিশেষায়িত কমিটি গঠনের বিষয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। তবে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনের আগে এ কমিটি গঠনের বিষয়ে মতবিরোধ রয়েছে।
এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহালের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলেও এ সরকারের মেয়াদ ও কাঠামোর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি দলগুলো।
দুই দিন বিরতির পর গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আবারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় সংলাপে ২৯টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি অংশ নেন।
সংলাপের শুরুতে জুলাই শহীদদের স্মরণে উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় আবারও সংলাপ শুরু হবে।
কমিশন সূত্র জানায়, সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সদ্য সাবেক প্রধান বিচারক বা না পেলে আপিল বিভাগের বিচারকদের মনোনীত করার এ ধারায় ‘জুডিশিয়ারি’ বাদ রেখে অন্য কাউকে রাখা যায় কি না সে বিষয়ে প্রস্তাব উত্থাপন হয়েছে। বিকল্প কারা হতে পারেন তা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। এ ছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সর্বশেষ বিধান রাষ্ট্রপতিকে প্রধান করার বিষয়েও আপত্তি জানানো হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে বিশদ আলোচনা হয়নি।
সংলাপ শেষে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সব রাজনৈতিক দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অভিন্ন মত পোষণ করে এবং এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ঐকমত্য আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন ও কাঠামো এবং এর এখতিয়ার নিয়েও আলোচনা হয়েছে এবং খোলামেলা আলোচনায় দলগুলো অনেক কাছাকাছি এসেছে। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে আলোচনায় উল্লেখযোগ্য ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সীমানা নির্ধারণ বিষয়ে আশু এবং দীর্ঘমেয়াদে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। আশু ব্যবস্থা হিসেবে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় যথাযথ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠন এবং সেই কমিটির পরামর্শক্রমে সংসদীয় এলাকা নির্ধারণ করা।
দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণ বিষয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, প্রতি আদমশুমারি বা অনধিক ১০ বছর পরে সংসদীয় নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণের জন্য সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১৯-এর দফা ১-এর (গ)-এর শেষে উল্লিখিত ‘এবং’ শব্দটির পর ‘আইনের দ্বারা নির্ধারিত একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠনের বিধান’ যুক্ত করা হবে। সংশ্লিষ্ট জাতীয় সংসদের সীমানা নির্ধারণ আইন ২০২১, যা ২০২৫ সালে সংশোধিত হয়েছে, তার ৮(৩) সঙ্গে যুক্ত করে ওই কমিটির গঠন ও কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হবে।
এর আগে সংলাপে সূচনা বক্তব্যে অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেন, সবার সহযোগিতা থাকলে চলতি জুলাইয়ের মাঝামাঝি জাতীয় সনদ প্রণয়নের প্রত্যাশা করি। রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় এ মাসের তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারব। সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থানের বিষয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, দলগতভাবে, জোটগতভাবে ব্যক্তিগতভাবে কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় কমিশনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ হয়েছে। যেগুলো আমাদের আশাবাদী করছে। আমরা মনে করি, সে জায়গায় পৌঁছাতে পারব। কারণ আমাদের সবারই আন্তরিক প্রচেষ্টা আছে। তিনি আরও বলেন, আমরা চেষ্টা করলে জুলাই মাসের মাঝামাঝি একটা সনদের জায়গায় যেতে পারব।
জুলাই সনদ প্রণয়নের বিষয়ে বিএনপি সব থেকে আন্তরিক বলে জানান দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, বিএনপির নামে সহযোগিতা না করার তকমা কেউ দেবেন না। কারণ ঐকমত্যের প্রয়োজনে চূডান্ত সহযোগিতা করেছে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বাহালের প্রস্তাব আমরা করেছি। সবাই সেখানে একমত প্রকাশ করেছে। তিনি বলেন, সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে সাংবিধানিক কমিশন গঠনের প্রস্তাব ছিল। আমরা বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছি। সেখানে দলগুলো কাছাকাছি চলে এসেছে। তিনি বলেন, সব বিষয়ে একমত হওয়ার জন্য আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা ঠিক না। আলোচনার মাধ্যমে যেসব বিষয়ে দলগুলো একমত হবে, সেগুলো নিয়েই এ সনদ স্বাক্ষরিত হবে। এ ক্ষেত্রে আমরা আশাবাদী।
জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে আগে নির্বাচন কমিশনই একান্তভাবে কাজটি করত। এখন স্বচ্ছতার জন্য একটু পরিবর্তন আনার কথা বলা হচ্ছে। সেটা হচ্ছে, একটি বিশেষায়িত কমিটি হবে। সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সে কমিটি নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সহযোগিতা ও সুপারিশ করবে। এটিকে দুভাবে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম হচ্ছে, সামনে যে জাতীয় নির্বাচনটি হবে, এতে আমাদের প্রস্তাব ছিল, ইসির অধীনে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হবে। কিন্তু সময় কম থাকায় এবার এ কমিটি গঠন সম্ভব নয়। ত্রয়োদশ নির্বাচনে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করবে ইসি, তাদের সুপারিশক্রমে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ করা হবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ঐকমত্য কমিশনের কাছে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের রূপরেখা দিয়েছে বলে জানান সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব। তিনি বলেন, বাংলাদেশে যখনই ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় হয়, তখন সরকারি দল, বিরোধী দল এবং অন্যান্য দলের মধ্যে একটা সংঘাতপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। ফলে আমরা দলের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এবং ঐকমত্য কমিশনের কাছে সুস্পষ্ট রূপরেখা দিয়েছি। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, সেখানে বিচারালয়কে টেনে এনে বিচারালয়কে রাজনীতিকরণ করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আমরা এটার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি। আমরা বলেছি, রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমেই এ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার প্রশ্নের সমাধান করতে হবে। উচ্চকক্ষ এবং নিম্নকক্ষের একটি ১১ সদস্যের পার্লামেন্টারি অল পার্টি কমিটির মাধ্যমে তাদের মধ্য থেকে তিনজন করে নাম প্রস্তাব করবে, যিনি প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন। ওই নামগুলো পাবলিক হবে। ১১ জনের কমিটি থেকে ভোটের মাধ্যমে যদি আট/তিন ভোটে পাস করেন, তিনি প্রধান উপদেষ্টা মনোনীত হবেন।