দেশের অন্যতম মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রতিষ্ঠান নগদ-এর মালিকানা ও পরিচালনা কাঠামো নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি অনিশ্চয়তা এবং প্রশাসনিক জটিলতা চরমে পৌঁছেছে। বিভিন্ন পক্ষের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান, আদালতের নির্দেশনা এবং সরকারের অভ্যন্তরে পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি- সব মিলিয়ে ‘নগদ’ এখন কার্যত এক ‘প্রশাসনিক সংঘাতের কেন্দ্রে’ পরিণত হয়েছে।
গত বছরের আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ-এর পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে দেয়। পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে সেই বোর্ড বাতিল হলেও তা আবারও পুনর্গঠন করা হয়। এরপর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ ত্যৈয়ব বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়ে নগদের নতুন পরিচালনা কাঠামো গঠনের পরামর্শ দেন। এরই ধারাবাহিকতায় গভর্নর অর্থ উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়ে নগদের অন্তর্বর্তী অনুমোদন বাতিলের সুপারিশ করেন।
নগদ পরিচালনা ও ভবিষ্যৎ কাঠামো সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক একাধিক প্রস্তাব দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়কে। এর মধ্যে রয়েছে নতুন কোম্পানি গঠন, সম্পদ ও দায় হস্তান্তর, কৌশলগত বেসরকারি বিনিয়োগ গ্রহণ এবং পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনসহ টেকসই কাঠামো প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন উদ্যোগ।
অন্যদিকে, ডাক অধিদপ্তর এসব প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলছে, নগদ একটি সরকারি সেবা এবং এটি ডাক বিভাগের মালিকানায় পরিচালিত হওয়াই জনগণের আস্থার উৎস। তারা মনে করছে, নতুনভাবে রেজিস্ট্রেশন করে মালিকানা ও লোগো পরিবর্তন হলে জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন হবে এবং সেবাটির ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে।
ডাক অধিদপ্তর আরও দাবি করেছে, নগদ-এর নামে কোনো হস্তান্তরযোগ্য সম্পদ বা দায় নেই। এটি সম্পূর্ণ সরকারি মালিকানাধীন হওয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তরের সুপারিশ সরকারি সম্পদ বেসরকারি খাতে দেওয়ার শামিল হবে, যা আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করছে, নগদকে ভবিষ্যৎে সোনালী ব্যাংক বা অন্য কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি হিসেবে গড়ে তোলাই হবে সর্বোত্তম পথ। প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক যৌথভাবে পরিচালনা করতে পারে এবং ভবিষ্যতে কৌশলগত বিনিয়োগকারীর কাছে এর আংশিক মালিকানা হস্তান্তর করা যেতে পারে।
তবে ডাক অধিদপ্তর বলছে, নগদ যদি সরকারি মালিকানাতেই থাকে, তবেই সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে এবং জনগণের আস্থা অক্ষুণ্ন থাকবে। বেসরকারিকরণ হলে দেশের ডিজিটাল আর্থিক খাতে একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ তৈরি হতে পারে, যা অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থি।
পরিচালনা পর্ষদ ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়ে জটিলতা : বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি নগদের জন্য সাত সদস্যের একটি নতুন পরিচালনা পর্ষদ গঠন করলেও তাতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহকে চেয়ারম্যান করা হয়নি। চেয়ারম্যান করা হয়েছে এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাইজার এ চৌধুরীকে। মোনাশ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহসহ সদস্য করা হয়েছে পিআরআইয়ের গবেষণা পরিচালক বজলুল হক খন্দকার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানিম হোসেইন শাওনকে। পাশাপাশি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) নিয়োগ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা না থাকায় নগদের কার্যক্রম পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে কারিগরি ও প্রশাসনিক সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছে ডাক বিভাগ।
ডাক অধিদপ্তর আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, একজন অস্থায়ী প্রশাসক দিয়ে প্রযুক্তি, সার্ভার নিয়ন্ত্রণ এবং বিদেশি প্রযুক্তি সরবরাহকারীদের সঙ্গে কাজ করাও কঠিন হবে। এতে পূর্বের জালিয়াতি তদন্ত ও কার্যকর প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ব্যাহত হতে পারে।