আদালত অবমাননা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা শাকিল আকন্দ বুলবুলকে দুই মাসের কারাদণ্ড দেন আদালত। গতকাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ রায় দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে ট্রাইব্যুনাল বলেন, বাদীসহ বিচারকাজের সঙ্গে জড়িতদের চরম পরিণতির হুমকি দেওয়া হয়েছে। এতে বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে। একসময়ের অন্যতম ক্ষমতাধর সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী এই প্রথম দণ্ডের মুখোমুখি হলেন।
ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশনের পক্ষে ছিলেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর তানভীর জোহা।
শেখ হাসিনা ও শাকিল আকন্দ বুলবুলের পক্ষে শুনানি করেন রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন। অ্যামিক্যাস কিউরি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ ওয়াই মশিউজ্জামান। পরে চিফ প্রসিকিউটর জানিয়েছেন, তারা (শেখ হাসিনা ও শাকিল) আদালতে আত্মসমর্পণের পর বা যেদিন গ্রেপ্তার হবেন, সেদিন থেকে এ সাজা কার্যকর হবে।
শেখ হাসিনা ও গাইবান্ধার আওয়ামী লীগ নেতা শাকিলের মধ্যে কথোপকথনের অডিও ভাইরাল হলে গত ৩০ এপ্রিল তাদের বিষয়ে ব্যাখ্যা চান ট্রাইব্যুনাল। তাদের হাজির হয়ে বা আইনজীবীর মাধ্যমে কথোপকথনের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছিল। ২৫ মে নির্ধারিত তারিখে তারা হাজির হননি কিংবা আইনজীবীর মাধ্যমেও ব্যাখ্যা দেননি। পরে দুই আসামি সশরীরে হাজির হয়ে জবাব দেওয়ার জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দিতে নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। নির্দেশ অনুযায়ী দুটি সংবাদপত্রে এ-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। এরপরও তারা হাজির হননি।
গতকাল শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেশের বিভন্ন থানায় ২২৭টি মামলা হয়েছে। ২২৭ জন আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। আমরা তাদের সাক্ষী নিচ্ছি। প্রত্যেকটি এফআইআর আমাদের ডকুমেন্ট। যেখানেই মামলা হবে তা চলে আসবে আমাদের এখানে। এ কথোপকথনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালসহ দেশের অন্যান্য আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোর সাক্ষী, তদন্ত কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হুমকি দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, তাদের দুজনের অডিও সিআইডি ফরেনসিক করেছে। স্পেশাল টিম এটি তদন্ত করেছে। এ বক্তব্য সঠিক। কেননা আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজ সক্রিয় রয়েছে। তারা সেখানে এ বিষয়টি অস্বীকার করেনি। পরে শেখ হাসিনার হুমকির ওই অডিও ট্রাইব্যুনালে শোনানো হয়।
শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সিনিয়র আইনজীবী এ ওয়াই মশিউজ্জামান বলেন, যে আসামি আত্মসমর্পণ করেছে অথচ আইনজীবী রাখার সামর্থ্য নেই তার জন্য স্টেট ডিফেন্স। এ আসামিরা তো কোর্টের সামনে আসেনি। তাহলে তাদের জন্য কেন স্টেট ডিফেন্স। আদালত বলেন, পলাতক থাকায় আমরা তাদের জন্য আইনজীবী দিয়েছি। এ ওয়াই মশিউজ্জামান বলেন, বিচার বাধাগ্রস্ত হয়েছে কি না বা হচ্ছে কি না সেটার সিদ্ধান্ত নেবেন ট্রাইব্যুনাল। কোর্ট যদি মনে করেন বিচার কেউ বাধাগ্রস্ত করছে সে ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নিতে পারেন।
দুজনের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন বলেন, যেসব ডকুমেন্ট এসেছে সেসব যারা পরীক্ষা করেছে তারা এখানে আসেনি। তারা যতক্ষণ না এসে বলবে ততক্ষণ পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না। রায়ের পর আইনজীবী আমির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, এই রায়ে আমি সন্তুষ্ট নই। তিনি বলেছেন, প্রসিকিউশন থেকে যে বক্তব্য রেখেছেন, তার সঙ্গে আমার দ্বিমত আছে। এদিকে রায়ের পর চিফ প্রসিকিউটর সাংবাদিকদের বলেন, সিআইডি ফরেনসিক পরীক্ষা করে দেখেছে অডিও ঠিক আছে। এটা কোনো এআই দিয়ে তৈরি নয়। এ কনভারসেশনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা তার মামলার বাদী, সাক্ষী, তদন্ত সংস্থা অর্থাৎ যারাই বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত তাদের হত্যা করা, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, নানানভাবে তাদের হুমকি দিয়েছেন। যেটা আইন অনুসারে অপরাধ। এটা প্রমাণিত হওয়ায় শেখ হাসিনা এবং শাকিলকে দণ্ডিত করেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে চিফ প্রসিকিউটর বলেন, অ্যামিকাস কিউরি বলেছেন- এটা (যে অপরাধ হয়েছে) বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার শামিল। তাই এটা অবমাননা হয়েছে বলে পজিটিভ মতামত দিয়েছেন। জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সময় দেশজুড়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা হয়েছে ২৭টি। এসব মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৩ জনকে। এখনো পলাতক ১৩২ জন। আসামিদের মধ্যে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে মারা গেছেন একজন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর কার্যালয় থেকে গত ২৫ জুন মামলা ও গ্রেপ্তারসংক্রান্ত এ তথ্য পাওয়া গেছে। চিফ প্রসিকিউটরের তথ্য অনুযায়ী, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেশের বিভন্ন থানায় ২২৭টি মামলা হয়েছে।