এক পক্ষকালজুড়ে বারবার আলোচিত হয়েছে মিয়ানমার, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ও আরসা নেতা আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনি প্রসঙ্গ। ১৪ মার্চ বাংলাদেশে সফররত জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী আশ্রয়শিবির বা উদ্বাস্তু ক্যাম্প সফর করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সফরকালে তাঁর সঙ্গে ছিলেন। রোহিঙ্গা শিবিরে ড. ইউনূস ও অ্যান্তোনিও গুতেরেস এক লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর সঙ্গে ইফতার করেন। এ সময় ড. ইউনূস তাঁর চিরাচরিত গ্রামীণ চেকের পাঞ্জাবি পরেন। আর অ্যান্তোনিও গুতেরেসের পরনে ছিল সাদা পাঞ্জাবি। সাদা পতাকা, সাদা কবুতর, সাদা বেলুন ইত্যাদি শান্তির প্রতীক বলে বিবেচিত হয়। তবে রোহিঙ্গাদের জীবনে বহুল কাক্সিক্ষত শান্তি আনতে এ সফর কতটুকু অবদান রাখতে পারবে, তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছে। এক লাখ রোহিঙ্গা একসঙ্গে বসে ইফতার করলেও বিশ্বের কোটি কোটি চোখ প্রচারমাধ্যমের কল্যাণে সেদিন রোহিঙ্গাদের বাস্তব অবস্থা প্রত্যক্ষ এবং অনুধাবন করার নতুন সুযোগ পেল। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের একটি কূটনৈতিক এবং প্রশাসনিক সাফল্য বলে বিবেচিত হতে পারে। সম্প্রতি ঢাকার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ফিলিস্তিন সংহতি কমিটি বাংলাদেশের সদস্যরা একত্রিত হয়েছিলেন। তাঁরা যুদ্ধবিরোধী আইন লঙ্ঘন করে ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশে করেন। যেখানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বরেণ্য অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ জাতিসংঘ একটা অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নারী, শিশু, হাসপাতালের রোগী ও ঘোষিত নিরাপত্তাশিবিরে আশ্রিতদের বোমা মেরে মৃত্যু নিশ্চিত করার জঘন্য অপরাধ থেকে ইসরায়েলকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘ। অন্যদিকে রাশিয়া কর্তৃক একচেটিয়া ইউক্রেন দখলপ্রক্রিয়াও থামাতে পারছে না জাতিসংঘ। ফলে বাম ঘরানার অর্থনীতিবিদ ও গবেষক আনু মুহাম্মদের পক্ষে এমন মন্তব্য করাটাই স্বাভাবিক। তবে এ কথাও সত্য যে, আন্তর্জাতিকভাবে সম্মিলিত চাপ প্রয়োগ ও বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জাতিসংঘের সমতুল্য অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান বা জাতিসংঘ মহাসচিবের চেয়েও উঁচু স্তরের কোনো বিশ্ব স্বীকৃত ব্যক্তিত্ব নেই।
নতুন দায়িত্ব নেওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পে মার্কিন জনগণের টাকা তথা মার্কিন সহায়তা বন্ধের ঘোষণা ও বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। তবে রোহিঙ্গাদের সহায়তাসহ বিশ্বের নির্বাচিত কিছু প্রকল্পে মার্কিন সহায়তা এ মুহূর্তে চলমান থাকলেও যেকোনো সময় তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্যসহায়তাসহ অন্যান্য সহায়তা অচিরেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। এমনই এক প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ মহাসচিব তাঁর বক্তৃতায় সর্বাধিক দেশ ও সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ও অব্যাহত সাহায্য সহায়তা নিশ্চিতের আশ্বাস দেন, যা নিঃসন্দেহে আশাজাগানিয়া। তবে নানা আঙ্গিকে ব্যতিক্রম ছিল দেশের অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যের কয়েকটি দিক। প্রথমত ড. ইউনূস বক্তব্য দিয়েছেন তাঁর নিজ জেলা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায়। এই ভাষার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভাষার অনেক মিল রয়েছে। তাই তাঁর বক্তব্য শুনে রোহিঙ্গারা তাদের সমস্যা সমাধানে তাদেরই একজন আপনজনকে (ড. ইউনূস) পেয়েছে বলে ভাবতে পারে এবং এই ভাবনার পর যেকোনো বিধ্বংসী বা ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকবে বলে প্রত্যাশা করা যায়।
দ্বিতীয়ত ড. ইউনূস তাদের আগামী ঈদ নিজ ভূখন্ড তথা ফেলে আসা বাড়িঘরে উদযাপনের ব্যবস্থা করে দিতে সচেষ্ট থাকার আশ্বাস দিয়েছেন। আপাতদৃষ্টিতে দীর্ঘদিনের রোহিঙ্গা সংকট এক বছরে সমাধান করার মতো জাদু ড. ইউনূস বা জগতের অন্য কারও আছে কিনা, এমন প্রশ্নের উদয় হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে এ কথা ভুললে চলবে না যে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন যখন কেবল দেশের শীর্ষ ধনীদের ক্রয় ও ব্যবহারের সাধ্যসীমায় ছিল, তখন মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, এমন দিন আসবে, যখন দেশের গৃহকর্মী তথা অতিসাধারণ মানুষের হাতেও মোবাইল ফোন থাকবে। সেদিন তাঁর কথাগুলো নিয়ে অনেকেই কটাক্ষ করেছেন। কিন্তু দৃঢ়চেতা ড. ইউনূস তাঁর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে জানেন, তা-ই প্রমাণ করেছেন। সুতরাং রোহিঙ্গারা আগামী ঈদের আগেই যদি নিজ ভূখন্ডে ফিরে যেতে পারে, তবে তা হবে ড. ইউনূসেরই স্বভাবজাত ব্যক্তিত্বের জাদু। বিশেষত বিদেশে ড. ইউনূসের একটি বক্তৃতা শুনতে আয়োজকদের কোটি টাকা গুনতে হয়। কারণ তিনি কথা নয়, কাজে বিশ্বাসী। তাই তাঁর কথা শুনেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া যায়। অথচ অর্বাচীনেরা বিনা পয়সায় তাঁর কথা শুনে এবং সেই কথা ধরে তর্কবিতর্ক জুড়ে দেয়। ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নিয়ে সেনাবাহিনী মাঠে থাকা সত্ত্বেও ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সহযোগীদের প্রকাশ্যে ও গোপনে সমালোচনা ও বিষোদগার করছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা। এমনটা বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই প্রায় অসম্ভব। এমন অসম্ভবকে সম্ভব করা একজন ড. ইউনূসকে ঘিরে তাই রোহিঙ্গা ও ভুক্তভোগী বাংলাদেশ নতুন স্বপ্নের জাল বুনতেই পারে। রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরত যাওয়ার পথে নানামুখী প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অন্তরায় রয়েছে। এমন একটি অন্তরায় হলো আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা) নামক জঙ্গি সংগঠনের সন্ত্রাস ও অপতৎপরতা। একটু পেছনে ফিরলেই দেখা যাবে- আরসার তৎপরতা প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে ২০১৬ সাল থেকে। ওই বছরের অক্টোবরের শুরুতে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে সে দেশের সীমান্ত চৌকিতে হামলা চালায় আরসা। এর ফলে সেখানকার বেশ কয়েকজন সীমান্তরক্ষী বা বর্ডার পুলিশ হতাহত হয়। ওই সময় হামলার দায় স্বীকার করে আরসার কমান্ডার আতাউল্লাহ অনলাইনে ভিডিও বার্তা দেন। ২০১৭ সালে রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর অন্তত ৩০টি চৌকিতে হামলা হয়। ওই হামলার জন্য মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসাকে দায়ী করেছিল। ফলে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর। সে সময় নিপীড়ন থেকে বাঁচতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। তাই আরসা তথা মহিবুল্লাহকে বলা যায় সর্বনাশের গোড়া।
সীমান্তের কাছাকাছি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থাকায় আরসা নানাভাবে লাভবান হয়। তারা অবৈধ অস্ত্র ও মাদক কারবারে যুক্ত করে বিপথগামী রোহিঙ্গাদের একাংশকে। এতে আর্থিকভাবে আরসা ও আতাউল্লাহ লাভবান হতে থাকে। রোহিঙ্গা শিবিরে বহু হত্যাকান্ড ঘটেছে বিগত বছরগুলোতে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহসহ আরও ছয়জন খুন হন রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে। ধারণা করা হয়, যারাই রোহিঙ্গাদের নিজ ভূখন্ডে ফিরিয়ে নিতে চায় বা অস্ত্র ও মাদক কারবারে বাধা দেয়, তাদেরই লাশ পাওয়া যায়। এর নেপথ্যে আরসাই মূলত কলকাঠি নাড়ে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আড়ালে আরসা তাদের ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার কথা বলেও মুসলিম দেশ ও সংগঠনের সহায়তা লাভ করে বলে তথ্য রয়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তৃতার পরেই রাজধানীর পার্শ্ববর্তী জেলা নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে আটক হয়েছেন আরসা কমান্ডার আতাউল্লাহ ও তার সঙ্গীরা। ঘটনাটা হয়তো কাকতালীয়, তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পথে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী অন্তত একটি বাধা অপসারণ হওয়ায় যেকোনো বিচারে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন পাওয়ার দাবি রাখে দেশের গোয়েন্দা ও পুলিশ বাহিনী। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন অনেকটাই চীনের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করে বলে আন্তর্জাতিক মহলের বদ্ধমূল ধারণা। গত ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবসে চীন সফরে যান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ বছরই পূরণ হবে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সুবর্ণজয়ন্তী। তাই একজন সম্মানিত ব্যক্তির মর্যাদা বিবেচনায় এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ৫০ বছরের সম্পর্কের সম্মানে, চীন আন্তরিকভাবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তা করবে বলে আশা করা যায়। তেমন আলোচনাই হয়েছে ড. ইউনূস ও শি জিনপিং বেঠকে। আমাদের দেশের সঙ্গে মিানমারের স্থলসীমান্তের প্রায় পুরোটাই এখন আরাকান আর্মি নামক সশস্ত্র যোদ্ধাদের দখলে। আরাকান আর্মি প্রতিদিনই তাদের দখল করা এলাকার সীমানা, আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি করছে। বলা চলে আরাকান আর্মি বর্তমানে রাখাইন ও তৎসংলগ্ন এলাকায় স্বাধীন রাজ্য বা প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রান্তে। স্বাধীন রাখাইন বা আরাকানের যাবতীয় উন্নয়ন কর্মকান্ডে বাংলাদেশ ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। আর এই সুযোগেই রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পথ খুলে যেতে পারে।
মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর দরজায় কড়া নাড়ছে। অথচ ইয়েমেন, মিয়ানমার, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, আফগানিস্তান, ভারতের নাগপুর ও কাশ্মীর, চীনের উইঘরসহ বহু দেশের মুসলমানদের বিপন্ন জীবনে ঈদ নিতান্তই বেঁচে থাকা আরেকটি সাধারণ দিন মাত্র। বিশেষত রোহিঙ্গা বহু শিশু আজ পর্যন্ত নিজ ভূখন্ডে ঈদ উদযাপন করতে পারেনি।
ধর্মপ্রাণ মুসলমান সম্প্রদায় ঈদের দিন তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে এবং পরলোকে যাওয়া নিকট আত্মীয়দের কবর জিয়ারত করে। আগামী ঈদে রোহিঙ্গারা তাদের নিজ ভূখন্ডে ফেরত যাবে এবং সেখানকার মাটিতে শুয়ে থাকা পূর্বপুরুষদের কবর জিয়ারত করবে, এমন স্বপ্নের কথাই বলেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। মহান আল্লাহ এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুযোগ প্রদান করুন এবং রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হয়ে যাক, এটাই হোক ঈদের একান্ত প্রার্থনা। আগামী বছরের ঈদের আগেই সম্পন্ন হোক রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন।
♦ লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : [email protected]