বাংলাদেশ একটি বৃহৎ ব-দ্বীপ। এ ভূমির বড় আশীর্বাদ, এটি বিশ্বের অন্যতম বিস্তৃত নদীব্যবস্থার অন্তর্গত। জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদীই এই ভূমিকে উর্বর করে। সহজ সেচ ব্যবস্থাপনায় এতে ফলে সোনার ফসল। তবে নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদী যেমন আশীর্বাদ, কিছু ঝুঁকিও আছে। বর্ষা মৌসুমে ৫৫-৬০ ভাগ জমি পানিতে তলিয়ে যায় এবং শুষ্ক মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কম পানি থাকে। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল ঘূর্ণিঝড়, টাইফুন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ঝুঁকিতে রয়েছে। সঠিক পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা সমগ্র কৃষির ও প্রান্তিক মানুষের উন্নয়নের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বন্যানিয়ন্ত্রণ, পানিনিষ্কাশন, সেচ, পানি সরবরাহ এবং সমন্বিত পানিব্যবস্থাপনা পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার মূল বিকাশক্ষেত্র। অবশ্যই বাংলাদেশের নদীমাতৃক
প্রতিবেশী- ভারত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার এবং চীনের সঙ্গে কৌশলগত সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে কৃষি-কূটনীতির প্রেক্ষাপটে। বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২০-২০২৫) টেকসই, নিরাপদ এবং বৈচিত্র্যময় খাদ্যপণ্য সরবরাহের জন্য কৃষি বাণিজ্যিকীকরণের ওপর বিশেষ নজর রেখেছে। আমাদের অবশ্যই কৃষি উৎপাদনব্যবস্থার টেকসই সম্প্রসারণ এবং বৈচিত্র্যকে সমর্থন করতে হবে, যা বিশ্ব ও স্থানীয় বাজারের সঙ্গে আরও ভালোভাবে সংহত, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি গ্রামীণ জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য, বিশেষ করে নারী এবং প্রান্তিক মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসবে।
বাংলাদেশে কৃষি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে। এসব শিল্প দেশীয় কৃষিপণ্যের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। পরিসংখ্যান বলছে, এ খাতটি দেশের প্রক্রিয়াজাতকৃত উৎপাদনের ক্ষেত্রে ২২ ভাগের বেশি অবদান রাখে, প্রায় ২০ ভাগ শ্রমশক্তি এখানে নিয়োজিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বাংলাদেশের কৃষিশিল্প ক্রমবর্ধমানভাবে রপ্তানি বাজারে তাদের উপস্থিতি সম্প্রসারণের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছে। দেশে প্রায় ৭০০টি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ উদ্যোগ রয়েছে, যার মধ্যে ছোট-বড় ইউনিট আছে। এর মধ্যে অন্তত ৩০টি ম্যানুফ্যাকচারিং প্রতিষ্ঠান ফল ও সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য বিশেষায়িত। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের জন্য বাংলাদেশেই কিন্তু একটি বড় বাজার রয়েছে। বাংলাদেশ অ্যাগ্রো-প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) বর্তমান সদস্য ৪৭৯টি প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে রপ্তানিকারক ২৪৪টি এবং কৃষিপ্রক্রিয়াজত পণ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৩৩টি।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের (ফোরআইআর) ফলে কৃষি উৎপাদন যেমন শিল্পের আকার পেয়েছে, কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বিকাশও সম্ভাবনাময় হয়ে উঠেছে। ইন্টারনেট অব থিংস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স এবং অন্যান্য উন্নত প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটানোর একটি যুগান্তকারী সুযোগ রয়েছে, কারণ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্য মূলত গ্রামীণ অর্থনীতিকে একটি রূপান্তরমূলক পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং গ্রামাঞ্চলে দক্ষ ব্যক্তিদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। ফোরআইআর বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা পরিচালনা করার জন্য একটি স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনার সুযোগ সৃষ্টি হবে। ফোরআইআর-এ কৃষি রোবটিক্স প্রযুক্তি ব্যবহারে শ্রমিক খরচ হ্রাস পাবে এবং নিরাপদ কৃষিপণ্যের গুণমান অটুট থাকবে, যা উন্নত বিশ্বে আমরা হরহামেশা দেখছি। কৃষকরা যাতে ইন্টারনেট এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে প্রবেশাধিকার পান এবং তাদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হালনাগাদ তথ্য সম্পর্কে অবগত থাকতে সক্ষম হন সেটি এখন ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণা দেওয়া সরকারের প্রধান চ্যালেঞ্জ, যেখানে স্মার্ট কৃষি বড় একটি নিয়ামক।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে বাংলাদেশ যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে তা মোকাবিলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাটি, পানি ও বনভূমির অবক্ষয় টেকসই কৃষির জন্য হুমকিস্বরূপ। উপরন্তু আবাদি জমির পরিমাণ কমছে এবং অনিশ্চিত আবহাওয়া কৃষি খাতে উন্নয়নের পথে উদ্বেগগুলোকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। প্রান্তিক ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি, বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ এবং মূল্যস্ফীতি মানুষের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে অবশ্যই টেকসই কৃষিপদ্ধতিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান খাদ্য চাহিদা মেটাতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে এবং তা সময়ের প্রয়োজনে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়াতে হবে। দেশের জন্য নিরাপদ ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে কৃষি উৎপাদনশীলতা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা অপরিহার্য।
এই সময়ে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। উন্নত কৌশল এবং কৃষিযন্ত্র ব্যবহার করে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য কৃষককে দক্ষ করে তোলা জরুরি। বর্তমান বাজারমূল্য নির্ধারণ, ফসল সংরক্ষণের একটি সামগ্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং তা বিতরণের ব্যবস্থা পুনর্গঠন করতে হবে, যার লক্ষ মূলত খরচ কমানো এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো এবং সাশ্রয়ী মূল্যে প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা। উৎপাদক এবং সরবরাহকারী হিসেবে কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। শস্যবিমা এবং চিকিৎসাবিমা উন্নত করার পাশাপাশি কৃষকদের পেনশন প্রকল্পের একটি বৈশ্বিক মডেল বাংলাদেশে প্রবর্তন করতে হবে। বর্তমান নিরাপত্তাবেষ্টনী এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ক্রয়ক্ষমতার ভিতর খাদ্যপ্রাপ্যতার বিষয়টি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। উন্নত কৃষি গবেষণায় মনোযোগ দিতে হবে। বিশেষ করে উন্নত স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তিভিত্তিক গবেষণার কথা বলছি। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ এবং কৃষি খাতে এর প্রায়োগিক ব্যবহারের জন্য কৌশলগত কাঠামো প্রয়োজন। কৃষিজমি এবং কৃষিসম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আইনি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে। কৃষিপণ্যের জন্য কর ছাড় এবং বিভিন্ন শস্যের গুরুত্ব বিবেচনা করে বছরভিত্তিক প্রণোদনা দিতে হবে। দেশব্যাপী জাতীয় কৃষি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকেন্দ্রীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনে পর্যাপ্ত এবং কার্যকরী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যেগুলো কৃষকের জন্য বাস্তবসম্মতভাবে সহজ ও কার্যকরী হবে। এগুলো সম্ভব হলে অর্থাৎ বাস্তবায়িত হলে আমরা একসঙ্গে একটি টেকসই/মজবুত পথে হাঁটতে পারব বলে বিশ্বাস রাখি। স্মার্ট বিপ্লব কৃষির দৃশ্যপটে একটি বিবর্তনমূলক পরিবর্তন আনবে যা আমরা সবাই বুঝতে পারছি। এটি কেবল কৃষি খাতকে শক্তিশালী করবে তা নয়, বরং কার্যকরভাবে আমাদের জীবনজীবিকা পরিবর্তন করবে। এটি আমাদের দারিদ্র্য এবং বৈষম্য দূর করতে সহায়তা করবে, যার বেশির ভাগই মানবসৃষ্ট। এই দারিদ্র্য ও বৈষম্য কখনোই স্মার্ট ফার্মিং প্রযুক্তির উপস্থিতিতে তৈরি হবে না। উন্নত বিশ্বে শতভাগ যান্ত্রিক কৃষিতে বড় বিনিয়োগে কৃষি উৎপাদনব্যবস্থাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে শিল্পের মাত্রায়। আমাদের জনসম্পদ রয়েছে, আছে উর্বর জমি ও কৃষি উপযোগী আবহাওয়া। ধীরে ধীরে কৃষিতে আগ্রহী উঠছেন শিল্পোদ্যোক্তারাও। যার বেশ কিছু নজির আমি ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে তুলে ধরেছি। আমাদের দেশে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যশস্য, ফলমূল ও সবজি উৎপাদন হয়। মৌসুমে উদ্বৃত্ত ফসল নষ্ট হয়। ফলে অ্যাগ্রো প্রসেসিংয়ে যাওয়া জরুরি। উপযুক্ত পরিবেশ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের নিশ্চয়তা তৈরি করা গেলে ব্যবসায়ীরা কৃষিতে বিনিয়োগ করবে এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ কৃষিতে অর্থ বিনিয়োগ করলে টাকা ফেরত পাওয়া যায়- এটা প্রমাণিত। উপযুক্ত কৃষি উৎপাদন ও বাণিজ্যিক পরিবেশ তৈরি হলে এ খাতে বিদেশিরাও বিনিয়োগ করবে। ভবিষ্যৎ বাণিজ্যই হচ্ছে কৃষি। অপরদিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৭টির মধ্যে ১০টি লক্ষ্যমাত্রা এবং এর অন্তর্গত ৩৩টি টার্গেটের সঙ্গে কৃষি খাতের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। ফলে আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কৃষিজ উৎপাদনশীলতা এবং ক্ষুদ্র পরিসর খাদ্য উৎপাদকদের আয় দ্বিগুণ করা। তাই শুধু কৃষিতে বাজেটে কৃষির জন্য থোক বরাদ্দ দিলেই হবে না।
পরের দশ থেকে পনেরো বছর কৃষির গতিপ্রকৃতি কেমন হবে- তা এখনই ভাবনার ভিতরে এনে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রত্যেকের মধ্যেই সম্ভাবনা রয়েছে এবং কৃষিসংশ্লিষ্ট সবাইকে স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তির বিশাল সম্ভাবনার জায়গাটি উপলব্ধি করতে হবে। যা আগামীর বাংলাদেশের কৃষির ভবিষ্যৎ আমূল পাল্টে দেবে। আমরা জানি, পরিবর্তন তখনই ঘটে যখন কোনো দূরদৃষ্টি থাকে। যখনই কৃষি কোনো মারাত্মক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় তখনই দ্রুত এটি সমাধানের দাবি রাখে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি সমাধান কী তা আমরা জানি না, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, আমাদের কৃষকরা সর্বদা মাটিতেই আছেন, তারা শুনছেন, শিখছেন এবং প্রতিদিন বিকশিত হচ্ছেন। একই অবস্থা সরকার, নীতিনির্ধারক, উন্নয়ন অংশীদার এবং কৃষি খাতের অন্যান্য অংশীজনের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য।
♦ লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব