টেলিভিশন নাটকে একসময় বৈচিত্র্য, নতুন মুখের উত্থান, চরিত্রের সঙ্গে শিল্পী নির্বাচন- সবই ছিল শিল্পের অংশ। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন টেলিভিশনে এমন একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, যাকে অনেকেই বলছেন ‘শিল্পী সিন্ডিকেট’। এ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ বা নাট্যপরিচালক-প্রযোজকরা বারবার একই মুখ, ভিউওয়ালা বা ভাইরাল অভিনয়শিল্পী বা নির্দিষ্ট একটি শিল্পী গোষ্ঠীকে নিয়ে কাজ করছেন। ফলে নতুন বা কম পরিচিত অভিনয়শিল্পীরা ন্যায্য সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ প্রবণতা শুধু প্রতিভার অগ্রযাত্রা থামিয়ে দিচ্ছে না, বরং নাটকের মান এবং দর্শকপ্রিয়তার ওপরও প্রভাব ফেলছে। আবার অনেক সময় দেখা যায়, একই শিল্পী একই ধরনের চরিত্রে একাধিক নাটকে অভিনয় করলে দর্শকদের কাছেও বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। আবার বিপরীত চিত্রও দেখা যায়। কিছু কিছু টিভি চ্যানেল বা নির্মাতারা চ্যালেঞ্জ নিয়ে নতুনদের সঙ্গে কাজ করছেন। উৎসাহ দিচ্ছেন ভালো কিছু করার, তবে সেটা খুবই নগণ্য।
সিন্ডিকেট কীভাবে কাজ করে?
নির্দিষ্ট কিছু জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী, পরিচালক এবং প্রযোজকের মাঝে একটি অনানুষ্ঠানিক সমঝোতা তৈরি হয়েছে। একটি নাটকের জন্য কাস্টিংয়ের সময় এ নির্ধারিত গোষ্ঠীর বাইরের কাউকে সুযোগ দেওয়ার প্রবণতা কম। নতুন কোনো শিল্পী প্রস্তাব করলেই বলা হয়- ‘দর্শক চেনে না’, ‘রেটিং আসবে না’, ভিউয়ারস-ফলোয়ারস নেই বা ‘ওকে নিলে সময়মতো শুটিং করা যাবে না’। কিন্তু প্রশ্ন হলো-এ ‘রেটিংমুখী’ যুক্তি কি শিল্পের বিকাশে সহায়ক? নাট্যজগতে এখন এমন অনেক শিখে আসা, প্রতিভাবান অভিনয়শিল্পী রয়েছেন, যাদের দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও টেলিভিশনে তেমনভাবে সুযোগ মিলছে না। তারা বাধ্য হচ্ছেন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চনাটকে সীমাবদ্ধ থাকতে।
প্রযোজক-পরিচালকদের ভাষ্য
এ বিষয়ে নির্মাতা-প্রযোজক মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ বলেন, ‘শিল্পী সিন্ডিকেট বলতে কিছুই নেই। পৃথিবীতে এটা মানুষের বানানো। আমি মনে করি, যোগ্যতা বা ট্যালেন্ট থাকলে কাউকে ঠেকানো যাবে না। মার্কেটিং, অ্যাক্টিং যোগ্যতা থাকলে সে একসময় দর্শকদের কাছে পৌঁছবেই। আমি কিন্তু নতুনদের অনেক সুযোগ দিয়েছি। তারা এখন অনেক কাজ করছে। তবে হ্যাঁ, কিছু ডিরেক্টর কিছু শিল্পীর ওপর নির্ভর করে, কমফোর্ট জোন মনে করে। তবে ডিরেক্টর তখনই খুশি যখন সে মনিটরে দেখে তার শিল্পীর ভালো অভিনয়।’ আরেক নির্মাতা-প্রযোজক দিপু হাজরা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এইটা অবশ্য নির্ভর করে টেলিভিশনে শিল্পীদের চাহিদার ওপর, ব্র্যান্ডিং ডিমান্ডের ওপর। যেহেতু এখন টিভি ছাড়াও তাদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে, তাই দুই মাধ্যমেই ভাবতে হয়। সবকিছু বিপণন বা ব্র্যান্ডিংয়ের আলোকে সাজাতে হয়। যেসব শিল্পীর হালনাগাদ ডিমান্ড থাকে, ট্রেন্ডিংয়ে থাকে বা ভিউ বেশি যাদের তাদের চাহিদা বেশি তো থাকবেই। সবকিছুর মূল কিন্তু ভিউজ। ভিউজ হলেই তো বাণিজ্য। তবে আমি যাদের সঙ্গে কাজ করি যেমন চঞ্চল চৌধুরী, বৃন্দাবন দাস, শাহনাজ খুশি, আ খ ম হাসান, শামীম জামান-তাদের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া ও ভালোবাসার ব্যাপার রয়েছে। তার সঙ্গে রয়েছে গল্প, চরিত্র আর কমফোর্ট জোন।’ নির্মাতা হাসান রেজাউল বলেন, ‘আমি অবশ্য সবাইকে নিয়েই কাজ করছি। তবে নির্ভরযোগ্য এবং পরিচিত শিল্পীদের নিয়ে কাজ করা সহজ। তাদের কাজের মান জানা আছে, শুটিংয়ে সময় মেনে আসেন, রিহার্সেলের প্রয়োজন কম, দর্শক চেনেন। এটি এক ধরনের ‘কম ঝুঁঁকির’ পন্থা।’
বিভিন্ন চ্যানেল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য
এ বিষয়ে ইবনে হাসান খান (ডিরেক্টর, সেলস অব মার্কেটিং, চ্যানেল আই) বলেন, ‘আমাদের টেলিভিশনে শিল্পী সিন্ডিকেট কখনোই ছিল না। আমি এ বিষয়টা একজন চ্যানেল ব্যবসায়ী হিসেবে কখনোই বিশ্বাস করি না। একজন ব্যবসায়ী হলে কীভাবে ব্যবসাটাকে নিরাপদ করা যাবে, সেটা কিন্তু ভাবতে হয়। আপনি বাজার করতে গেলে তো ভালো পণ্যটাই কিনবেন, তাই না? আমি মনে করি, আজকে যারা নতুন তারাই ভালো কাজ দিয়ে একসময় জনপ্রিয় হয়। আর যেসব নায়ক-নায়িকা বা শিল্পী যে সময়ে জনপ্রিয় থাকে তাকে নিয়েই সবাই কাজ করে। যেমন আমরা এবার ঈদে মোশাররফ করিমকে নিয়ে তিনটি নাটক করেছি ভালো ব্যবসা করার জন্যই। যেহেতু টিভি চ্যানেল একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, তাই বাণিজ্যের দিক তো খেয়ালই করতে হবে।’ এ বিষয়ে তাশিক আহমেদ (উপদেষ্টা, সম্প্রচার বিভাগ, এটিএন বাংলা) বলেন, ‘আমাদের কোনো রিজার্ভেশন বা সিন্ডিকেশন নেই যে অমুক শিল্পীকে নিয়ে নাটকে কাজ করতে হবে। আমরা যারা মেধাবী, প্রতিশ্রুতিশীল-সম্ভাবনাময় তাদেরই সুযোগ দিই। তবে হ্যাঁ, নাটকে এ সময়ের ট্রেন্ডিংয়ে ৬-৭ জন ছেলেমেয়ে রয়েছে যাদের পারফরম্যান্স ভালো, পপুলারিটি রয়েছে। তাদের নিয়ে কাজ তো সবাই করতে চায়। কারণ, টিভি চ্যানেলের বিপণন চায় ব্র্যান্ডিং ভ্যালু, ট্রেন্ডি কনটেন্ট। নাটকের মান, শিল্পীর ওপর নির্ভর করেই তারা চ্যালেঞ্জ নেয়। গল্পের গভীরতার সঙ্গে ভালো ম্যাটেরিয়াল, শিল্পী আর মার্কেট ভ্যালু বিবেচনা করেই কাজ করতে হয়। এরপর থাকে নির্মাতার সঙ্গে শিল্পীর কমফোর্ট জোন। ভালো আর্টিস্ট নিয়ে ৮ লাখ ইনভেস্ট করে যদি ৬ লাখ টাকা লাভ হয় তাহলে কেন নয়! ইউটিউব থেকে ইনকামেরও চেষ্টা থাকে। তবে নতুন আর্টিস্টে রিস্ক বেশি থাকে, যেটি পপুলার আর্টিস্টের ক্ষেত্রে কম।’ এ টেলিভিশনে শিল্পী সিন্ডিকেটের বিষয়টিও বিশ্বাস করেন না বাংলাভিশনের হেড অব প্রোগ্রাম তারেক আখন্দ। তিনি বলেন, ‘সবার বিষয় জানি না; আমাদেরটা বলতে পারব যে, সিন্ডিকেশন নেই। তবে বাজার ভেবে আমাদের কাজ করতে হয়। মানের দিক বিবেচনা করে ভালো ডিরেক্টর, গল্প, কাস্টিং চিন্তা করতে হয়। রোমান্টিক গল্পের কাস্টিং একরকম, কমেডি বা অন্য ধরনের আরেক রকম কাস্টিং। সেক্ষেত্রে নির্মাতাদের সাজেশনও নেই। তবে আমাদের মূল টার্গেট থাকে বেশি দর্শকদের দেখানো। এ সময়ে যারা জনপ্রিয় তাদের নিয়েই তো কাজ করতে হয় বিপণনের স্বার্থে। তবে আমরা কিন্তু ১০% নতুনদের নিয়ে কাজ করি। তবে বিপণন করতে সমন্বয় লাগে যেন দর্শক পছন্দ করেন। এবার চ্যালেঞ্জ নিয়ে দুটি নাটকে নতুন নায়ক-নায়িকাকে কাস্ট করেছি। এটি রিস্ক, কিন্তু যদি ক্লিক করে তাহলে তারা আরও কাজ করবেন। আপনি দেখেন, সত্যজিৎ রায়ের আমল থেকেই ভালো গল্পের সঙ্গে ভালো কাস্টিং প্রচলন রয়েছে। সেটা উত্তম-সুচিত্রার কথাই যদি বলি। এরাও তো একসময় নতুন ছিল। তবে মানের প্রশ্নে আপস ঠিক নয়।’ এদিকে এ প্রসঙ্গে এনটিভির অনুষ্ঠান ও যোগাযোগ বিভাগের ব্যবস্থাপক পাভেল ইসলাম বলেন, ‘এরকম কোনো বিষয় আমাদের চ্যানেলে নেই। আমারও জানা নেই। ঈদের বিশেষ নাটক-টেলিফিল্ম ছাড়া রেগুলার নাটকে সব ধরনের শিল্পীই কাজ করে থাকেন। ডিমান্ড বা খাওয়ানোর জায়গা থেকে কাজ হয় না। মান ঠিক রেখে ভালো কাজ। তবে যারা ভালো আর্টিস্ট বা যাদের ভিউ-পপুলারিটি আছে তারা তো থাকবেই। পপুলার বা ভিউওয়ালা আর্টিস্ট কিন্তু খুব বেশি নেই, তাও ১৪-১৫ জন। সেগুলো মধ্য থেকেই ব্র্যান্ড ভ্যালু রয়েছে যাদের তাদেরকে নিয়ে নাটক বানানোর ডিমান্ড থাকে। আমাদের করার কিছুই থাকে না। বিপণনদাতাদের চাহিদাকে প্রাধান্য দিতে হয়। আমরা সামনের ঈদে এ সময়ের জনপ্রিয় নিলয়, হিমি, খায়রুল বাসার, ইয়াশ রোহান, আরশ খান, সুনেরাহ, তটিনী, কেয়া পায়েল, সামিরা মাহি, জোভান, নাজনীন নেহা, অপূর্ব, তৌসিফ, নওবা তাহিয়া, পার্থ শেখ, মোশাররফ করিমসহ অনেককে নিয়ে নাটক বানিয়েছি।’
এদিকে নাটক সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন এ টেলিভিশন শিল্পী সিন্ডিকেট শিল্পী নির্বাচনকে স্বচ্ছ ও নীতিগতভাবে পরিচালনা করা জরুরি। এক্ষেত্রে টিভি কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নাট্যপাড়ার গঠনমূলক আলোচনা, অ্যাক্টরস ইকুইটিসহ প্রযোজক সংঘের সক্রিয়তা এবং মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোর দায়িত্বশীলতা এ সমস্যা নিরসনে ভূমিকা রাখতে পারে। তরুণ পরিচালকদের উৎসাহিত করতে হবে যেন তারা ভিন্ন মুখ ও নতুন প্রতিভা নিয়ে কাজ করেন। কারণ, শিল্পের ক্ষেত্রে বন্ধ দরজা কোনো দিনই ভালো ফল বয়ে আনে না। টেলিভিশন নাটক যদি সৃষ্টিশীলতার জায়গা ধরে রাখতে চায়, তবে সিন্ডিকেট সংস্কৃতি ভাঙতেই হবে।