নিজের ও জাতির কিডনি স্বাস্থ্য সুরক্ষা করতে হলে তিনটি শব্দের অর্থ খুব ভালো করে বুঝতে হবে। Common-ব্যাপক, Harmful-ভয়াবহ, Preventable-প্রতিরোধযোগ্য। অর্থাৎ কিডনি রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপক, পরিণতি ভয়াবহ হলেও এ রোগ প্রতিরোধযোগ্য। বিশ্বে শুধু দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বা সিকেডি রোগীর সংখ্যা ৮৫ কোটির বেশি। এ রোগের হার দিনদিন বাড়ছে। উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশে এ রোগের হার অনেক বেশি। বিভিন্ন পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ। যদি কিডনি রোগ প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করে চিকিৎসা না করা যায়, তবে কিডনি ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায়, যার চিকিৎসা ব্যয় অত্যন্ত বেশি। বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৪০ হাজার রোগীর কিডনি বিকল হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। আরও ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ আকস্মিক কিডনি বিকলে আক্রান্ত হন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে ১৯৯০ সালে কিডনি রোগ ছিল ১৯তম স্থানে। বর্তমানে এসেছে সপ্তম স্থানে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৪০ সালে দাঁড়াবে পঞ্চম স্থানে। কিডনি রোগ মারাত্মক বা ভয়াবহ কেন? প্রথমত ৭০ থেকে ৯০ ভাগ নষ্ট হওয়ার আগে অনেক ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণ দেখা দেয় না। তাই এ রোগকে বলা হয় নীরব ঘাতক। দ্বিতীয়ত কিডনি রোগ অন্য রোগের ঝুঁকি অনেক গুণে বাড়িয়ে দেয়। এ জন্য কিডনি রোগকে বলা হয় ডিজিজ মাল্টিপ্লাইয়ার। যেমন স্বল্প মাত্রায়ও সিকেডি থাকলে হৃদরোগে মৃত্যুর ঝুঁকি ১০ গুণ বেড়ে যেতে পারে। তেমনি আরও অনেক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তৃতীয়ত কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেলে তার চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, আমাদের দেশে ১০ ভাগ লোকও তা বহন করতে পারে না। ফলে ৮০-৯০ ভাগ কিডনি বিকল রোগীর অকালমৃত্যু হয়। চিকিৎসা খরচ মেটাতে অনেক পরিবার দেউলিয়া হয়ে যায়। আশার বিষয় এই যে, কিডনি রোগ প্রতিরোধযোগ্য। যেখানে অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে ১০ ভাগ লোক চিকিৎসা নিতে হিমশিম খায়, সেখানে একটু সচেতন হলে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে এই ভয়াবহ কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা যায়।
প্রতিরোধের প্রধান দুটি উপায় : প্রথমত প্রাথমিক অবস্থায় সুপ্ত কিডনি রোগ নির্ণয় করে তা চিকিৎসা করা। যারা কিডনি রোগের ঝুঁকিতে আছে তাদের মাত্র দুটি সহজ পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগ নির্ণয় করা যায়, একটি প্রস্রাবে প্রোটিন যায় কি না। অন্যটি রক্তের ক্রিয়েটিনিন থেকে ইজিএফআর নির্ণয় করে কিডনি কত ভাগ কাজ করছে তা নির্ণয় করা যায়। এ দুটি পরীক্ষা প্রাথমিক পর্যায়ের হাসপাতালেও করা যেতে পারে। কিডনি রোগের ঝুঁকিতে আছে কারা? যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, বংশে কিডনি রোগ আছে, ধূমপায়ী, মাদকসেবী, অতিরিক্ত ওজন, বেশিদিন ব্যথার বড়ি খেয়েছে, বারবার কিডনিতে পাথর বা মূত্রতন্ত্রের প্রদাহ হয়। শিশুকালে কিডনি রোগ থাকলে। এমনকি বয়স ৫০-এর ওপরে গেলে কিডনি রোগের ঝুঁকি বাড়ে। যারা ঝুঁকিতে আছেন তাদের বছরে অন্তত দুবার কিডনি পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত।
সুস্থ জীবনধারা : কিডনি ভালো রাখতে সুস্থ জীবনধারা চর্চা অপরিহার্য। আটটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় নিয়মিত মেনে চললে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায়। ১. নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রম। ২. উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ। ৩. সুষম ও পরিমিত খাবার গ্রহণ। ৪. পর্যাপ্ত পানি পান। ৫. ওজন নিয়ন্ত্রণ। ৬. ধূমপান ও মাদক পরিহার। ৭. ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ সেবন। ৮. নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা।
কিডনি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রধান চ্যালেঞ্জ : ১. সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব। কিডনি রোগের ঝুঁকি, লক্ষণ সম্পর্কে অজ্ঞতা, চিকিৎসা সম্পর্কে ভুল ধারণা। ২. প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার সুযোগ সীমিত। অনেক অঞ্চলে কিডনি রোগ নির্ণয়ের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা। ৩. আর্থিক সীমাবদ্ধতা-ডায়ালাইসিস ও কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের ব্যয় অনেক বেশি। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা বা বাজেটের অভাব। ৪. কিডনি বিশেষজ্ঞ ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর স্বল্পতা। জাপানে প্রতি মিলিয়ন লোকের জন্য ৩৪ জন কিডনি বিশেষজ্ঞ, পক্ষান্তরে বাংলাদেশে আছে দুজনেরও কম। অন্যদিকে সাধারণ চিকিৎসকরা কিডনি সম্পর্কে কম সচেতন। ৫. অস্বাস্থ্যকর জীবনধারা ও ঝুঁকির কারণ বৃদ্ধি। যেমন ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ ক্রমাগত বাড়ছে। ৬. সাংস্কৃতিক ও কুসংস্কার, ঝাড়, ফুঁক, কবিরাজ, হারবাল চর্চা করতে গিয়ে বিলম্বে রোগ নির্ণয়ও কিডনি বিকলের ঝুঁকি বাড়ে।
উত্তরণের উপায় : নীতিনির্ধারক, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নীতিনির্ধারকদের কিডনি রোগ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য জাতীয় পর্যায়ে স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম চালু করা। সুলভ মূল্যে চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ করা। উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। চিকিৎসকদের কিডনি রোগের প্রাথমিক চিকিৎসায় প্রশিক্ষণ দেওয়া। জনসচেতনতা বাড়াতে কমিউনিটি আউটরিচ প্রোগ্রাম ও বিনামূল্যে স্ক্রিনিং ক্যাম্পের আয়োজন করা। চিকিৎসার ব্যয় কমানো ও সহায়তা প্রদানে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভূমিকা রাখতে পারে। কিডনি রোগীদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু এবং মাইক্রোফাইন্যান্স বা স্বল্প সুদের ঋণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সাশ্রয়ী কিডনি চিকিৎসা গবেষণা ও উদ্ভাবনে সহায়তা করতে হবে। আসুন, কিডনি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সবাই মিলে একযোগে কাজ করি।
লেখক : সভাপতি, কিডনি অ্যাওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটি (ক্যাম্পস)
