আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ ঘোষণায় উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে ১৮ কোটি মানুষের গর্বিত জাতি। এ দেশের মানুষ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল সত্তরের নির্বাচনে জয়ী জনপ্রতিনিধিদের হাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি ও গণহত্যার প্রতিবাদে। ২০২৪-এর জুলাই গণ অভ্যুত্থান ছিল গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ক্ষোভের ফসল। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসেছে দেশবাসীর ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার পূরণের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা কারণে জনমনে সংশয় সৃষ্টি হলেও তা কেটে যায় প্রধান উপদেষ্টার বাস্তবমুখী ভূমিকায়। দেশবাসীর দাবি ছিল ডিসেম্বর বা তার আগেই নির্বাচন আহ্বান করা হবে। জাতি নতুন বছরে পা দেবে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের সময়ে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর দাবিও ছিল অভিন্ন। তবে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল এপ্রিল নাগাদ নির্বাচন হবে। জুন-জুলাইয়ে নির্বাচন করার কথাও বলা হচ্ছিল সরকারি মহল থেকে। পায়ের নিচে মাটি নেই সরকারের আশীর্বাদপ্রাপ্ত এমন কিছু দল সংস্কারের পর নির্বাচনের তত্ত্বে গলা ফাটাচ্ছিল। গায়ে মানে না আপনি মোড়লদের কেউ কেউ পাঁচ বছর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় থেকে দেশকে বেহেশত বানিয়ে দিক এমন আবদারও তুলছিল। বাধ্য হয়ে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নামার হুমকি দেয়। সরকারের জন্য টিকে থাকার চ্যালেঞ্জও সৃষ্টি হয়। আন্দোলনের পরিণাম কী হবে, তা তাদের জানা ছিল। এ প্রেক্ষাপটে লন্ডনে এ সময়ের অবিসংবাদিত নেতা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হয়। সিদ্ধান্ত হয় রোজার আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন হবে। ৫ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ-সংক্রান্ত রোডম্যাপ ঘোষণা করেন। নির্বাচন ঘোষণার মালিক-মোক্তার যেহেতু নির্বাচন কমিশন, সেহেতু সরকারের পক্ষ থেকে তাদের গ্রিন সিগন্যালও পাঠানো হয়। দেশে নির্বাচিত সরকার আসার সম্ভাবনায় বিপাকে পড়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের কুশীলবরা। তারা সব হারানোর আতঙ্কে আঁতকে ওঠে। গত এক বছরে চাঁদাবাজি করে কোটিপতি বনে যাওয়া হঠাৎ রাজনীতিকরাও ক্ষিপ্ত হয় নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণায়। তাদের পক্ষ থেকে সাফ সাফ বলা হচ্ছে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হবে না। প্রকাশ্যেই বলা হয়েছে, তাদের পরিকল্পনার কথা। বিদেশি শক্তির তলপিবাহক কোনো কোনো এনজিও জনমত জরিপের নামে নিজেদের উর্বর মস্তিষ্কের খায়েশ প্রকারান্তরে প্রকাশ করছে। বলা হচ্ছে, জনগণ নাকি সংস্কার ছাড়া নির্বাচন চায় না। নির্বাচন প্রশ্নে প্রধান উপদেষ্টার সদিচ্ছার অভাব যে নেই, তা স্পষ্ট। তবে সরকারের মধ্যেও রয়েছে নির্বাচন যাতে না হয়, এমন কুশীলবরা। ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা যাদের নেই, তাদের মুখেও শোভা পাচ্ছে বড় বড় কথা। মহলবিশেষ সংস্কার আগে, তারপর নির্বাচনতত্ত্ব তুলে বা ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে কি না, জনমনে প্রশ্ন উঠেছে। তারা পতিত স্বৈরাচারের ফিরে আসার পথ খুলে দিচ্ছে কি না, সে আশঙ্কাও জোরদার হয়ে উঠেছে। কারণ গত এক বছরে দেশের মানুষ অনির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, আইনশৃঙ্খলার অবনতি এবং মব সন্ত্রাসই শুধু উপহার পেয়েছে। প্রকাশ্যে না থাকলেও পতিত সরকারের সমর্থকরা এ বিষয়ে তৃণমূল পর্যায়ে প্রচারণা চালাচ্ছে। বিশেষ করে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা একটি দলের কর্মকাণ্ডে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। কিংস পার্টি বলে পরিচিত ওই দলটির কার্যকলাপের দায় পড়ছে সরকারের ঘাড়ে। বিশেষ করে নির্বাচন বানচালের যে হুমকি তারা দিয়ে বেড়াচ্ছে, তা অন্তর্বর্তী সরকারের সদিচ্ছা সম্পর্কে প্রশ্ন সৃষ্টি করছে।
আগেই বলেছি, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে বদ্ধপরিকর। মালয়েশিয়া সফরকালেও তিনি তা স্পষ্ট করেছেন। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশনকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। ডিসেম্বরে তফসিল ঘোষণার কথা জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। দেশবাসী চায় সরকার তাদের প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকবে। ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করার জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের আয়োজিত সমাবেশগুলোতে নেতা-কর্মী-সমর্থকদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি নির্বাচনকে সামনে রেখে মহল বিশেষের অপতৎপরতা রোধের তাগিদ দিয়েছেন। ১৭ আগস্ট কবি-সাহিত্যিকদের এক সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে স্বৈরাচারের পাশাপাশি মৌলবাদী শক্তির উত্থান ঠেকাতে কবি-সাহিত্যিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, নাগরিকরা এ দেশের মালিক। নাগরিকদের বাকস্বাধীনতা রক্ষা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দরকার। মানুষের বাকস্বাধীনতার জন্য কবিরা অতীতে যেরকম ভূমিকা রেখেছিলেন ভবিষ্যতেও সেরকম ভূমিকা রাখতে হবে। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন। রবীন্দ্রনাথও কবিতায় মানবতার গান গেয়েছেন। একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি, জাতির পতাকা খামচে ধরেছে আজ পুরোনো শকুন ইত্যাদি কবিতা ও গানে আমাদের কবি-সাহিত্যিকরা দেশের ক্রান্তিলগ্নে এগিয়ে এসেছেন। ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে শিল্পী ও কবিদের দেশাত্মবোধের কথা জাতি চিরদিন মনে রাখবে। রবিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের আবদুস সালাম হল মিলনায়তনে বিএনপি মিডিয়া সেল ও জাতীয় কবিতা পরিষদ আয়োজিত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তারেক রহমান যে বক্তব্য রেখেছেন তা সময়োপযোগী ও তাৎপর্যপূর্ণ। গণতন্ত্র এমন এক মতবাদ যেখানে পরমতসহিষ্ণুতা ও ধর্মীয় উগ্রবাদের কোনো ঠাঁই নেই। ৫ আগস্ট কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন হলেও মৌলবাদীরা গণ অভ্যুত্থানের সুফল গিলে খাওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত আচরণে জুলাই গণ অভ্যুত্থানে গড়ে ওঠা জাতীয় ঐক্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ছে।
মৌলবাদীরা নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রকারান্তরে পতিত স্বৈরাচারের হাতকে শক্তিশালী করছে। বিশেষ করে আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থার দাবি করে তারা বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রাখার যে অপখেলায় যুক্ত হয়েছে, তা দুর্ভাগ্যজনক। দেশের এই ক্রান্তিকালে কবি-সাহিত্যিকদের ভূমিকা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দেশে মৌলবাদের উত্থান হলে তার পরিণতি যে পতিত স্বৈরাচারের আমলের চেয়ে ভয়াবহ হবে, সে বিষয়ে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে কবি-সাহিত্যিকদের উদ্যোগী হতে হবে। জাতীয় অগ্রগতির স্বার্থে নির্বাচনে সত্যিকারের গণতন্ত্রকামীরা যাতে নির্বাচিত হয়, সে প্রয়াস চালাতে হবে নিজেদের স্বার্থেই।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, আটটি অঙ্গীকারনামা ও ৮৪টি প্রস্তাবনা উল্লেখ করে জুলাই জাতীয় সনদের প্রস্তাবনা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের প্রস্তাবনায় মনে হয় ঐক্য অনৈক্যের দোলাচলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জুলাই সনদ দুলছে। রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক দেশের জনগণ।
তাদের দ্বারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা নির্ধারণ করতে পারেন কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। এ মুহূর্তে দেশে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার নেই। নেই নির্বাচিত সংসদ। ফলে জুলাই গণ অভ্যুত্থানের প্রত্যাশা পূরণে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ প্রণয়ন ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু কমিশন যে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে তার ১০টি প্রস্তাব বাস্তবতাবর্জিত। যে কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছে। বিএনপি মনে করে সংবিধানকে পাশ কাটিয়ে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।
লেখক : বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব, সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসুর জিএস