সমাজে অপরাধের মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে নৃশংস অপরাধের মাত্রা। অনেক বছর আগে পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড, এর অনেক পরে বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ডসহ আরো কিছু নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে এসব নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্যে বেশ বিরতি আমরা লক্ষ করেছি।
সম্প্রতি এমনকি নিকট অতীতে আমরা ক্রমাগত এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখতে পাচ্ছি। পুরান ঢাকায় পাথর দিয়ে হত্যাকাণ্ড অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। আমরা এমন নৃশংস পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড অতীতে দেখেছি বলে মনে হয় না। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে এখন প্রায়ই নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখছি।
অতি সম্প্রতি গাজীপুরে একজন সাংবাদিককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করার ঘটনা আমাদের জানিয়ে দেয় যে আমরা কোনোভাবেই নিরাপদ নই। নাজুক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিই আমাদের কাছে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী বলে মনে হয়। শিল্পনগরী হিসেবে গাজীপুরে অনেক মানুষের বসবাস। ঢাকার কাছাকাছি এবং অন্যান্য জেলার সঙ্গে যোগাযোগ ভালো হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এখানে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অপরাধেরও অনেক ঝুঁকি রয়েছে।
আমরা প্রচলিত ও স্বাভাবিক অপরাধের জগৎ থেকে বেরিয়ে এখন নৃশংস অপরাধের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছি। সমাজে অন্যান্য অপরাধ যেমন চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই আছে এবং এসবের মাত্রাও অনেক বেড়েছে। মানুষ নিজেদের বাঁচানোর জন্য নানা রকম উদ্যোগ নিচ্ছে। গাজীপুরের কোনো কোনো এলাকা এবং হবিগঞ্জের মানুষ রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। এ দুটো জায়গার খরব আমরা পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারি, কিন্তু বাস্তব চিত্র হয়তো ভিন্ন। আবার নিরাপত্তার কথা ভেবে কেউ কেউ স্থান পরিবর্তনও করছে। এককথায় বলতে গেলে সমাজের সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যেই অপরাধ বৃদ্ধির মারাত্মক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে।
বেকারত্ব কিংবা কর্মহীনতাকে অপরাধের একটি কারণ হিসেবে আমরা উল্লেখ করতে পারি। এ কথা সত্য মানুষ কর্মহীন হলে জীবিকার তাগিদে অন্যায় ও অপরাধ করতে পারে। সেসব অপরাধ অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। মানুষ চুরি কিংবা ডাকাতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করবে। নিকট অতীতে অনেক শিল্প-কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। এ কারণে জীবিকার সঙ্গে যুক্ত অপরাধের মাত্রা বাড়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু পূর্বপরিকল্পিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনে অর্থনীতি যতটা না দায়ী তার চেয়ে বেশি দায়ী মনোসামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়, যা দূরীকরণে আমাদের ভিন্নপথ অবলম্বন করতে হবে। আবার অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্রনীতি যা-ই বলি না কেন প্রতিটি বিষয় একটি অপরটির সঙ্গে যুক্ত। সমাজে প্রতিপত্তি ও বলয় তৈরি এবং নীতিহীনতা আমাদের সমাজকাঠামোর ওপর দারুণ প্রভাব ফেলছে। আর সব কিছুর ওপরে যে বিষয়টি আছে তা হলো সামাজিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা। প্রচলিত নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এখন কার্যত অচল।
পরিবার কিংবা পাড়ার বয়োজ্যেষ্ঠ এমনকি পরিবার প্রধানও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেকে অচল এবং অকার্যকর ভাবছেন। সামাজিক সংগঠন, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, সমিতি, সংঘসহ স্থানীয় সরকারও কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভূমিকা কার্যত এখনো নাজুক রয়েছে। দ্বিতীয়ত, তাদের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্ক ও যোগাযোগ রেখে কাজ করতে হয়। এ সম্পর্ককে আমরা বলি কমিউনিটি পুলিশিং। আমার কাছে মনে হয় এমন প্রতিষ্ঠানও আজকে অচল। আমাদের অবস্থা এমন যেন সবাই গুটিয়ে বসে আছি। স্থানীয় সরকার কোনো না কোনো ভূমিকা পালন করতে পারলেও বর্তমানে তা কার্যত অচল । সামগ্রিক পেক্ষাপট এমন যে আমরা সবাই যেন গুটিয়ে বসে আছি।
নৃশংসতা কোনো স্বাভাবিক অপরাধ নয়। মানুষের মধ্যে বিকৃত মানসিকতা কিংবা ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিসত্তা না থাকলে মানুষ এমন সব নৃশংস আচরণ করতে পারে না। যদিও আর্থিক প্রলোভন সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে, কিন্তু তার মধ্যে উপরোক্ত মানসিকতা থাকতে হবে। আবার এমন অপরাধ না করার পেছনে আইন এবং শাস্তির ভয় কাজ করে। অপরাধীর প্রতি মানুষের ঘৃণাও কাজ করতে পারে। কিন্তু আমরা দেখছি কোনোটাই কার্যকর নয়। যদি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভয় কাজ করত, তাহলে ভয়ংকর অপরাধীরা নিজেকে নৃশংস অপরাধ থেকে দূরে রাখত। কঠোর শাস্তির ভয় থাকলেও অপরাধীরা অপরাধ থেকে দূরে থাকত। আর মানুষের ঘৃণা এখন পুরোপুরি ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। এগুলোর অন্যতম কারণ আমাদের পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে গলদ। পুরো প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থাহীনতা। পুরো প্রক্রিয়া সঠিকভাবে কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা। এসব দিয়ে আমরা কিভাবে সমাজ থেকে নৃশংস আচরণ দূর করব।
আমরা দুটি প্রেক্ষাপট জানি। একটি আইনগত আর অন্যটি সামাজিক। দুটি একটি অপরটির পুরিপূরক। একে অপরের সহযোগিতা ছাড়া কাজ করতে পারে না। একজন একক নাগরিক হিসেবে আমরা আজ অসহায়। কেননা নৃশংস আচরণ একা প্রতিরোধ করা কষ্টসাধ্য। আমাদের সাহসেরও আজ বড় অভাব। যতক্ষণ না আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ভূমিকা যথাযথভাবে পালন না করে, যতক্ষণ না আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো কার্যকর হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কোনো পদক্ষেপই কার্যকরী হবে বলে মনে হয় না। সামাজিক অর্থে আমরাও আজ অনেকটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়ে পড়েছি।
আমরা মনে করি, আমাদের কী করার আছে? আমরা একে অপরকে দোষারোপও করি। কিন্তু সমাজের প্রতি আমাদের যে কিছু দায়িত্ব আছে, তা সেভাবে স্বীকার করতে চাই না। আমাদের দরকার এমন একটি সমাজকাঠামো যেখানে সমাজিক প্রতিষ্ঠান, সংঘ, সমিতি, মোটাদাগে পরিবার ও সমাজ কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান কঠোর হয়ে সব কিছু মোকাবেলা করবে। অন্যথায় সাধারণ কিংবা নৃশংস অপরাধ কোনোটাই সঠিকভাবে প্রতিরোধ করা যাবে না বা কঠিন হবে।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ