বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি খুবই নাজুক। বিশেষ করে গাজায় মানবিক বিরতি ঘোষণার পরও চলছে ইসরায়েলের হামলা। সেখানে এমন দিন যায় না, যেদিন ইসরায়েলিরা ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে না। এ ক্ষেত্রে নারী বা শিশু কেউ নিস্তার পাচ্ছে না।
বিশ্বের দু-চারটি দেশ ছাড়া এই হত্যাযজ্ঞকে কোনো দেশই সমর্থন করছে না। কিন্তু তাতে কি থামছে মানবতার এই লঙ্ঘন? মানবতা হত্যাকারীদের কে থামাবে? জাতিসংঘের কি সেই ক্ষমতা আছে? দরিদ্র আর পিছিয়ে পড়া দেশগুলো ছাড়া কে শোনে জাতিসংঘের কথা? সেই শক্তি আছে যার, সে তো নিজেই ওই সব কর্মকাণ্ডে জড়িত। কমবেশি একই অবস্থা অন্যান্য দেশে। যারা উচ্চৈঃস্বরে মানবতার কথা বলে, তারাই বিশ্বব্যাপী হত্যাসহ নানা অমানবিক কাজকর্ম করে যাচ্ছে, আর বিশ্ববাসী নীরব দর্শক হয়ে তা দেখছে।
তা সত্ত্বেও বছর ঘুরে আবারও এসেছে বিশ্ব মানবতা দিবস। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২০০৯ সালে ১৯ আগস্টকে বিশ্ব মানবতা দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই প্রতিবছর এই দিনে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। উল্লেখ্য, ২০০৩ সালের ১৯ আগস্ট ইরাকের রাজধানী বাগদাদের ক্যানাল হোটেলে অবস্থিত জাতিসংঘ দপ্তরে এক বোমা হামলায় ইরাকে কর্মরত জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি সার্জিও ভিয়েরা ডি মেলোসহ ২২ জন মানবতাকর্মীর প্রাণহানি ঘটে। মূলত তাঁদের স্মরণে এই দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলেও বিশ্বের সব মানবিক সেবায় নিয়োজিতদের, বিশেষ করে মানবিক সেবাদানকালে যাঁরা নিহত বা আহত হয়েছেন, সবাইকেই সম্মান জানানো হয়ে থাকে।
যুদ্ধ, সংঘাতপূর্ণ অঞ্চল বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার বিপন্ন মানুষকে জীবন রক্ষাকারী সহায়তা এবং সুরক্ষা প্রদান করার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাঁরা বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়ান, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বিভিন্ন আয়োজন করা হয় এই দিবসটিতে। তা ছাড়া দিবসটিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানবিক কাজকর্মের গুরুত্ব, কার্যকারিতা এবং ইতিবাচক প্রভাব নিয়েও আলোচনা করা হয়। যাঁরা এই মহতী প্রচেষ্টায় নিজেদের সম্পৃক্ত করে থাকেন, তাঁদের প্রতি সমর্থন এবং তাঁদের সুরক্ষার জন্যও আহবান জানানো হয় দিবসটিতে।
প্রতিবছরই দিবসটি পালনের উদ্দেশ্যে একটি নির্দিষ্ট প্রতিপাদ্য গ্রহণ করা হয়, যাতে সংকটে থাকা মানুষের সুরক্ষা, মর্যাদা এবং কল্যাণের পাশাপাশি সাহায্যকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য মানবিক অংশীদারদের একত্র করা যায়। এ বছর দিবসটি পালনের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘বিশ্বব্যাপী সংহতি জোরদার করা এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন’।
প্রতিপাদ্যটি কেবল সুবিধাভোগী হিসেবে নয়, বরং সক্রিয় অংশগ্রহণকারী এবং নেতৃত্ব প্রদানকারী হিসেবে তাদের নিজস্ব ভবিষ্যৎ গঠনে সম্প্রদায়ের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর জোর দেয়। বিশ্বে মানবতা আজ যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় সম্পর্কে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সচেতন করা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার মানসিকতা সৃষ্টির মাধ্যমে তাদের শক্তিশালী করে গড়ে তোলাই এবারের প্রতিপাদ্যের মূল উদ্দেশ্য। এ ছাড়া একটি মানবিক বিশ্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিশ্বের সব জনগোষ্ঠীকে মানবিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে তাদের মধ্যে সংহতি জোরদার করার কথাও বলা হয়েছে প্রতিপাদ্যটিতে।
মানবিক কর্মীরা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলমান দুর্যোগ ও সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে কাজ করে ভুক্তভোগী মানুষের পাশে দাঁড়ান, এমনকি খাদ্যের মতো মৌলিক প্রয়োজনীয়তাও সরবরাহ করে থাকেন। এসব করতে গিয়ে তাঁদের অনেকেই প্রাণ হারান। আজকে গাজা, ইউক্রেন, সুদান, মায়ানমার, ইয়েমেন ইত্যাদি অঞ্চলে সংঘটিত সংঘাতের কারণে মানবতা চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। সেখানে কাজ করতে গিয়ে অনেক মানবিক কর্মীর প্রাণহানি ঘটেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, শুধু গাজার যুদ্ধে ২২৪ জনেরও বেশি মানবিক কর্মীর প্রাণহানি ঘটেছে, যার মধ্যে ১৯০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের সহায়তাকারী জাতিসংঘের সংস্থা এবং অন্যান্য সংস্থার কর্মী। জাতিসংঘের প্রতিবেদন মতে, ২০২৩ সালে ১৯৬ জন সাহায্যকর্মী আহত হয়েছেন, ৭৮ জন অপহৃত হয়েছেন এবং ২৬১ জন নিহত হয়েছেন, যা আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
২০২৪ সালের মে মাস থেকে বাংলাদেশ কয়েকটি নজিরবিহীন এবং ধ্বংসাত্মক জলবায়ু সম্পর্কিত দুর্যোগের দ্বারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে ঘূর্ণিঝড় রিমাল, হাওর অঞ্চলে আকস্মিক বন্যা, যমুনা অববাহিকায় নদীর তীরবর্তী ও পূর্বাঞ্চলে বন্যা। এসব ক্ষেত্রে জরুরি ত্রাণ ও সহায়তা প্রদান করা ছাড়াও রোহিঙ্গা সংকটের ক্ষেত্রে জাতিসংঘ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজ বাসভূমিতে সুষ্ঠু ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমে স্থায়ী সমাধানে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। রোহিঙ্গাদের ঘরে ফেরার আর্তনাদ শুধু মায়ানমারের সামরিক জান্তারই নয়, তার পেছনে থাকা শক্তিধর কারো কর্ণকুহরে প্রবেশ করছে না। আর সেটি না হওয়া পর্যন্ত মানবতার যত কথাই বিশ্ববাসী উচ্চারণ করুক না কেন, তাতে কাজ হবে না।
বর্তমান বাংলাদেশে মানবতাচর্চার বিষয়টি কতটুকু গুরুত্ব পাচ্ছে, সে প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। সেই চর্চা হোক সরকারি বা বেসরকারিভাবে, বলতে গেলে নেই বললেই চলে। এর পেছনে যেমন রাজনৈতিক কারণ রয়েছে, তেমনি রয়েছে আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব। রাজনৈতিক কোন্দল, রেষারেষি বা দলীয় প্রভাবে প্রায়ই অমানবিক কর্মকাণ্ড ঘটে। ইদানীং ‘মব’ নামের ঘোরপ্যাঁচে মানুষ হত্যাসহ অনেক অমানবিক কর্মকাণ্ডই অহরহ ঘটে যাচ্ছে। আমরা এমনও দেখেছি যে ওই সব কর্মকাণ্ড থামাতে পুলিশও ব্যর্থ হচ্ছে। মানবতা এভাবে আর কতকাল গুমরে গুমরে কাঁদবে? আমাদের কি কিছুই করার নেই?
আসলে বাংলাদেশে মানবতা রক্ষণ এবং বিকাশ নিয়ে আমার মতো অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে। আমাদের দেশে শিক্ষিত মানুষের হার অনেক বেড়েছে, কিন্তু ওই শিক্ষিতদের মধ্যে কতজনকে আমরা মানবিক করে তুলতে পেরেছি? একটি শিশুকে ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি মানবিক গুণাবলি অর্জনের শিক্ষা দিতে হবে। শিশুটি বড় হয়ে শুধু একজন শিক্ষিত মানুষই নয়, একজন মানবিক মানুষ হবে। এ জন্য পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমাজ, দেশ তথা বিশ্বকে মানবিক করতে হলে মানুষকে মানবিক করে গড়ে তোলার বিকল্প নেই। সমাজের প্রতিটি সদস্য যাতে তার সামর্থ্য অনুযায়ী অন্যের বিপদে এগিয়ে আসে, মানবিক কর্মীদের পাশে দাঁড়ায় এবং তাদের সুরক্ষায় অংশ নেয়, সে ব্যাপারে সবাইকে অনুপ্রাণিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আরো মানবিক-তৎপর হতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে জনগণকেও তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সমর্থন দিতে হবে। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ কথাটি স্মরণ করে আমরা কি মানুষের প্রতি আরো মানবিক হতে পারি না? হয়তো আমাদের একটু সাহায্যই একজনের জীবন বাঁচাতে পারে, একজন নিরীহ মানুষকে তথাকথিত ‘মব’ নৃশংসতা থেকে রক্ষা করতে পারে। আমরা কি আজকের দিনে একটি মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিতে পারি না?
শেষ কথা, যেসব কারণ মানবতার জন্য হুমকি, সেসবের সমাধান অধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর হয়তো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষের হাত থাকে না, কিন্তু মানবসৃষ্ট হুমকি বন্ধ করতে হবে। আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই, মানবিক বিশ্ব চাই।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব