ডেনমার্কের যুবরাজ ছাড়া যেমন ‘হ্যামলেট’ নাটক কল্পনা করা যায় না, তেমনি জন মেইনার্ড কেইনসকে (১৮৮৩-১৯৪৬) বাদ দিয়ে অর্থনৈতিক মন্দায় সরকারি ব্যয়ের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা অনেকটা অর্থহীন। কেইনস ছাড়া দ্বিতীয় কোনো অর্থনীতিবিদ তাঁর নীতি-উপদেশ দিয়ে রাজনীতিবিদদের ওপর এত প্রবল প্রভাব ফেলেছেন বলে জানা নেই। বিশ্বখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের মতে, ‘কেইনস সবচেয়ে তীক্ষ এবং পরিষ্কার বোদ্ধা। যখন তাঁর সঙ্গে (কেইনসের সঙ্গে) যুক্তি প্রদর্শন করতাম, মনে হতো যেন জীবনটা আমি হাতে নিয়েছি এবং প্রায়ই নিজেকে বোকা ঠাহর করে বের হতাম।’
দুই
ত্রিশ শতকের মহামন্দা কাটিয়ে ওঠার পথ খুঁজতে যখন বিশ্বের সেরা সেরা মাথা মহাব্যস্ত, তখন ব্রিটেনের ট্রেজারি (অর্থ মন্ত্রণালয়) ধৈর্য ধরার সুপারিশ এবং আশ্বস্ত করেছিল যে দীর্ঘ মেয়াদে সব ঠিক হয়ে যাবে। এই কথা শুনে কেইনস খেপে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দীর্ঘ মেয়াদে আমরা সবাই মৃত। সুতরাং যা করতে হবে, স্বল্প মেয়াদে করতে হবে।’ কেইনসের ক্যাপসুল ফর্মুলা এলো, সরকারি কিংবা বেসরকারি ব্যয় বাড়াও এবং সেটিই হচ্ছে মন্দার বিপক্ষে প্রয়োগ করার মতো মহৌষধ। এর কারণ খুব সহজেই অনুমেয়, অর্থনৈতিক মন্দা তখনই ঘটে, যখন পণ্য ও সেবার মোট চাহিদা মোট আয়ের চেয়ে কম হয়। কেইনস সাবধান করে দিয়ে খানা ও ব্যবসার অপর্যাপ্ত চাহিদার কথা বলেছেন। তারা যদি যথেষ্ট ক্রয় না করে, মালিক কর্মচারী ছাঁটাই করে দেবেন এবং উৎপাদন হ্রাস করবেন। কেইনসীয় মতবাদে সরকারের ভূমিকা খুব বেশি। কর হ্রাস করে অথবা বেশি ব্যয় করে সরকার সরাসরি অর্থনীতির ডুবন্ত জাহাজকে রক্ষা করতে পারে। এটিই হচ্ছে মন্দার বিপরীতে কেইনসের ক্যাপসুল প্রেসক্রিপশন। কেইনস বলতেন, অর্থনীতিবিদদের দন্ত চিকিৎসকের মতো প্রায়োগিক হতে হবে; রোগী-নির্বিশেষে একই দাঁত খোঁচালে কজন আর দন্ত চিকিৎসকের হেলানো চেয়ারে হাঁ করে বসে থাকবে?
তিন
অর্থনৈতিক মন্দা ও রিসিশনের মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। মন্দা (ডিপ্রেশন) হচ্ছে সেই অবস্থা, যখন অব্যাহতভাবে এবং দীর্ঘ সময় ধরে সবকিছুই নিম্নমুখী হয়। অর্থাৎ যখন উৎপাদন, কেনাকাটা, কর্মসংস্থান ইত্যাদিতে ব্যাপক ধস নামে। আর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সাময়িক স্থবিরতা (রিসিশন) হচ্ছে মোট উৎপাদন আয় এবং কর্মসংস্থানে তাৎপর্যপূর্ণ হ্রাস, বিশেষত ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত, যখন অর্থনীতির অনেক খাতে বহুবিস্তৃত সংকোচন প্রত্যক্ষ করা যায়। রিসিশন অর্থনৈতিক মন্দারই অপেক্ষাকৃত একটি নমনীয় ধরন, যদিও এটি মন্দার বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ধারণ করে। এই পার্থক্য সম্পর্কে সাবেক এবং প্রয়াত মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগানের একটি কৌতুকপূর্ণ কথা আছে। ১৯৮০ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সঙ্গে ভোটযুদ্ধে নেমে তিনি বলেছিলেন, ‘রিসিশন হচ্ছে, যখন আপনার প্রতিবেশী তার চাকরি হারায়, আর ডিপ্রেশন হচ্ছে, যখন আপনি আপনার চাকরি হারান। রিকভারি হচ্ছে, যখন জিমি কার্টার তাঁর চাকরি হারান।’
চার
যা হোক, পুনরুক্তি যদিও, লর্ড মেইনার্ড কেইনস খুব সংক্ষেপে মন্দার মর্মার্থ তুলে ধরেছেন এভাবে : খানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পণ্য ও সেবার অপর্যাপ্ত চাহিদার কারণে ব্যবসায়ী চাকরি থেকে ছাঁটাই করেন এবং উৎপাদন কমিয়ে দেন। যেহেতু খানাগুলো বেশি করে পণ্য কেনে, সামগ্রিক চাহিদা সম্প্রসারণে খানার ভূমিকা বেশ বড় থাকে। একটি খানা কতটুকু ব্যয় করবে, তা নির্ভর করে খুব তাৎপর্যপূর্ণ উপাদান পরিবারের আকার, রুচি ও প্রত্যাশার ওপর। তবে আয় হচ্ছে চাহিদার প্রধান চালক। আয় বাড়লে খানা বেশি কিনবে, আয় কমলে কম কিনবে। কেইনস ধরে নিয়েছেন যে যখনই কারো হাতে একটি অতিরিক্ত ডলার বা টাকা আসে, সে অতিরিক্ত ডলারের বা টাকার বেশির ভাগ খরচ করবে এবং বাকিটা সঞ্চয় করবে। কেইনস এটিকে বলেছেন প্রান্তিক ভোগপ্রবণতা। শুধু ভোক্তা কেন, যন্ত্রপাতি ও মজুদে বিনিয়োগ করে ব্যবসায়ীমহলও সার্বিক চাহিদায় অবদান রাখে। বিনিয়োগ নির্ভর করে মূলত প্রত্যাশা, সুদের হার, আস্থা, আবহাওয়া এবং রাজনীতি- এই সবকিছুর ওপর। মোটকথা, পূর্ণ কর্মসংস্থানসমেত একটি শক্তিশালী অর্থনীতি পেতে হলে খানাগুলোকে যথেষ্ট ভোগ ব্যয় করতে হবে এবং একই সঙ্গে ব্যবসায়ীমহলকে পণ্য বিক্রিতে যথেষ্ট বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে বিক্রির পরিমাণ উৎপাদনের সমান হয়। অতএব কেইনসীয় অর্থনীতি তত্ত্বে বা কেইনসীয় মতবাদের দুটি মৌলিক উপাদান হচ্ছে, (ক) ব্যক্তি অর্থনীতি পূর্ণ কর্মসংস্থানে না-ও পৌঁছাতে পারে এবং (খ) সরকারি ব্যয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে এই ব্যবধান দূর করতে পারে।
পাঁচ
ব্যক্তির ব্যয় কিভাবে অর্থনীতিকে ব্যাধিমুক্ত করে? নিজের ব্যয় নিজের জন্য, সরকারি ব্যয় সবার জন্য। ব্যয়ের একটি অর্থনীতি তো আছেই এবং সে জন্যই প্রতিবছর সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি পায়। সরকারি ব্যয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে বেশ বড় ভূমিকা রাখে; যেমন- রাস্তাঘাট নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ মালপত্র পরিবহনে সুযোগ করে দেয়; বিদ্যুৎ প্লান্টের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ ঘটিয়ে উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব হয়; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় মানুষের উৎপাদিকা শক্তি বৃদ্ধি করত মানবপুঁজি সংঘটনে সহায়তা দেয়। অন্যদিকে আছে দেশ রক্ষা ও আইন-শৃঙ্খলা, সিভিল প্রশাসন, গবেষণা ও উন্নয়ন ইত্যাদি খাতে ব্যয়, যেসব কর্মকাণ্ডে ব্যক্তি খাত নানা কারণে খুব একটা এগিয়ে আসে না বলে সরকারকে ব্যয় বৃদ্ধির দায়িত্ব নিতে হয়। বলা দরকার যে এসব ব্যয় সাধারণত তাৎক্ষণিক কোনো উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটায় না, তবে মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে জিডিপি বৃদ্ধিতে অবদান রাখে এবং উৎপাদনের উপকরণগুলোর প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে।
যদি কোনো ব্যক্তি বা খানা তার সবটুকু আয় খরচ করে ফেলে, সে ক্ষেত্রে প্রান্তিক ভোগপ্রবণতার মান হবে ১। অর্থাৎ ১ টাকার অতিরিক্ত আয় সমান ১ টাকার অতিরিক্ত ব্যয়। ধরা যাক, ‘ফ্রেন্ডস অ্যান্ড ফ্রেন্ডস কোং’ কারখানায় একটি অতিরিক্ত রুম বানাতে গিয়ে ১০০ ডলার খরচ করল। তাহলে মোট ব্যয় বাড়ল ১০০ ডলার। মিস্ত্রি, নকশাবিদ ও অন্যান্য রসদ ক্রয়ের পেছনে। প্রশ্ন হলো, যাদের কাছে ১০০ ডলার গেল, তারা বাড়িতে এসে ওই ডলার দিয়ে কী করে? নিশ্চয় কিছু না কিছু কেনাকাটা করে এবং বাকিটা সঞ্চয় করে। যারা এই দ্রব্যগুলো বিক্রি করে, তাদের আয় বেড়ে যায় এবং তারাও অতিরিক্ত আয় নানা কাজে ব্যয় করে থাকে।
ছয়
বুঝতে কষ্ট হয় না যে প্রান্তিক ভোগপ্রবণতা যত বেশি হবে, গুণক তত বেশি হবে। আর প্রান্তিক সঞ্চয়প্রবণতা যত বেশি হবে, গুণক তত কম হবে। এই সূত্র ধরে যে কারণেই হোক, বিনিয়োগ একটু কমলেই মানুষের আয় কমে যাবে, চাহিদা হ্রাস পাবে এবং অর্থনীতিতে বিরাট চাপ সৃষ্টি হবে। যদি মানুষ অতিরিক্ত আয়ের এক-তৃতীয়াংশ সঞ্চয় করে (তার মানে দুই-তৃতীয়াংশ ব্যয় করে), তাহলে গুণক হবে ৩। আর সে ক্ষেত্রে যদি কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বা বাংলাদেশের সরকার পাঁচ কোটি টাকার বিনিয়োগ হ্রাস করে, তাহলে জাতীয় আয় কমে যাবে ১৫ কোটি টাকার। সুতরাং চাহিদার ঘাটতি যদি সাময়িক অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণ হয়, তাহলে এই রোগের ওষুধ হলো সরকারি বা বেসরকারি ব্যয় বাড়ানো। এভাবে যদি প্রান্তিক ভোগপ্রবণতা দেওয়া থাকে, তাহলে গুণক সম্পর্কে ধারণা নিয়ে কত টাকা অর্থনীতিতে ঢাললে উৎপাদন ও বিক্রির ঘাটতি পূরণ হবে, তা-ও জানা যায়। এ ক্ষেত্রে বিশেষত সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।
ধরা যাক, বাংলাদেশে চাহিদার ঘাটতি ১২ কোটি টাকার পরিমাণ স্থবিরতা জন্ম দেয় এবং এ দেশে হিসাবকৃত প্রান্তিক ভোগপ্রবণতা দুই-তৃতীয়াংশ, তাহলে অর্থগুণক হবে ৩ এবং যার মানে চার কোটি টাকার সরকারি ব্যয় কর্মসূচি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে এই ব্যবধান ঘোচাতে সাহায্য করতে পারে। সুতরাং এটি কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয় যে মন্দা বা রিসিশনের সময় সরকার নানা উপায়ে সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব ও মুদ্রানীতির ওপর ভর করে। বলা বাহুল্য, এখন সময় এসেছে সম্প্রসারণমূলক মুদ্রানীতির। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি প্রবৃদ্ধি হ্রাস করে। তবে অবশ্যই দুর্নীতি ও অপচয়ের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। আফটার অল, মাথা ব্যথার জন্য তো আর মাথা কেটে ফেলে দেওয়া যায় না।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
বিডি-প্রতিদিন/আব্দুল্লাহ