জুলাই-আগস্ট গণ অভ্যুত্থানের সময় গুলিবিদ্ধ আন্দোলনকারীদের চিকিৎসা প্রদানে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাধা দেওয়ার বর্ণনা উঠে এসেছে দুই চিকিৎসকের জবানবন্দিতে।
গতকাল বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ প্রসিকিউশনের সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দিয়েছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিওরো সাইন্স অ্যান্ড হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. মাহফুজুর রহমান ও ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কল্যাণপুর শাখার সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাসানুল বান্না।
ডা. মাহফুজুর রহমান জবানবন্দিতে বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল। তখন ডিবির লোকেরা এসে নতুন গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের ভর্তি না করার জন্য আমাকে চাপ দেয়। বলে আপনি অতি উৎসাহী হবেন না, আপনি বিপদে পড়বেন।’
ডা. হাসানুল বান্না জবানবন্দিতে বলেন, ‘১৮ জুলাই সন্ধ্যার পর পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হাসপাতালে এসে চিকিৎসা প্রদানে বাধা দেয় এবং রোগী ভর্তি করতে নিষেধ করে। ১৯ জুলাই সকাল থেকে সারা দিন যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় সন্ত্রাসীরা হাসপাতালের গেট অবরোধ করে রাখে।’ এসব ঘটনার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতসহ যারা গুলি চালিয়েছে তাদের দায়ী করে ট্রাইব্যুনালের কাছে বিচার চান এ দুই চিকিৎসক।
অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রসিকিউশনের ত্রয়োদশ ও পঞ্চদশ সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন এই দুই চিকিৎসক। মাঝে প্রসিকিউশনের চতুর্দশ সাক্ষী ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিওরো সাইন্স অ্যান্ড হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স শাহনাজ পারভিন জব্দ তালিকার সাক্ষী হিসেবে নিজের জবানবন্দি দেন। পরে এই মামলার পলাতক আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী মো. আমির হোসেন সাক্ষীদের জেরা করেন। মামলার একমাত্র গ্রেপ্তারকৃত সাক্ষী ও রাজসাক্ষী সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন আসামির কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন।
গতকাল দিনের শেষে গত বছর ৫ আগস্ট সকালে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত মেহেদী হাসান জুনায়েদের মা প্রসিকিউশনের সপ্তম সাক্ষী সোনিয়া জামাল জবানবন্দি তুলে ধরেন। পরে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাকে জেরা করেন। শেখ হাসিনার মামলায় পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী রবিবার ও চানখাঁরপুল মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আজকের দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
এদিন প্রসিকিউশনের পক্ষে ট্রাইব্যুনালে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম, গাজী এম এইচ তামীম, বি এম সুলতান মাহমুদ, আবদুস সাত্তার পালোয়ান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
চিকিৎসায় বাধা দেয় ডিবি : ৪৭ বছর বয়সি ডা. মো. মাহফুজুর রহমান নিজের জবানবন্দিতে বলেন, ‘২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আবু সাঈদ নিহত হওয়ার ঘটনা জানার পর আমি আমাদের পরিচালক মহোদয়ের সঙ্গে পরামর্শ করি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় পরিচালক মহোদয়ের নির্দেশনায় একটি ইমার্জেন্সি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়। ১৮ জুলাই থেকে গুলিবিদ্ধ রোগী আসতে থাকে। রোগীদের মাথায়, হাতে, পায়ে, পিঠে, মুখে, গলায় গুলি ও পিলেটবিদ্ধ ছিল। গুলিগুলো ছিল বড় সাইজের।’ তিনি বলেন, ৪ থেকে ৫ আগস্ট যেসব রোগী আসে তাদের অধিকাংশের মাথায়, বুকে, মুখে গলায় গুলিবিদ্ধ ছিল। বেশির ভাগের মাথার খুলি ছিল না।’
নিজেদের হাসপাতালের চিকিৎসার পরিসংখ্যান জানিয়ে ডা. মাহফুজ জবানবন্দিতে আরও বলেন, ‘৫৭৫ জন গুলি ও পিলেটবিদ্ধ রোগীকে বহিঃবিভাগে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে অনেককেই হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সিট সংকুলান না হওয়ায় এবং গুরুতর আহত রোগীর চাপ বেশি থাকায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। গুরুতর আহত ১৬৭ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের বেশির ভাগেরই মাথার খুলি ছিল না। তাদের মধ্যে চারজনকে মৃত অবস্থায় আনা হয়। ২৯ জন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। সাতজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য থাইল্যান্ডে পাঠানো হয়।’ বাধা দেওয়ার ঘটনা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘১৯ জুলাই যখন রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছিল তখন ডিবির লোকেরা এসে নতুন গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের ভর্তি না করার জন্য আমাকে চাপ দেয়। বলে আপনি অতি উৎসাহী হবেন না, আপনি বিপদে পড়বেন। তারা আরও বলে যাদের ভর্তি করেছেন তাদের রিলিজ করবেন না-এ বিষয়ে ওপরের নির্দেশ আছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তখন আমরা কৌশলে ভর্তি রেজিস্টারে রোগীদের জখমের ধরন পরিবর্তন করে গুলিবিদ্ধের স্থলে রোড এক্সিডেন্ট বা অন্যান্য কারণ লিপিবদ্ধ করে ভর্তি করি। আহত রোগীদের বয়স ছিল ১৩-৩০ এর মধ্যে। তাদের অধিকাংশই ছিল শিক্ষার্থী।’
হাসপাতালের গেট অবরোধ করে রাখে : ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কল্যাণপুর শাখার সহযোগী অধ্যাপক ৪৩ বছর বয়সি চিকিৎসক হাসানুল বান্না জবানবন্দিতে বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব চলাকালীন ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই এবং আগস্টের ২, ৩, ৪ ও ৫ তারিখ এবং পরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে চিকিৎসা প্রদান করি। ১৮ জুলাই দুপুরের পর থেকে আমাদের হাসপাতালে অসংখ্য আহত ব্যক্তি এলে আমরা চিকিৎসা প্রদান শুরু করি। যাদের অনেকের অপারেশন করতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘১৮ জুলাই সন্ধ্যার পর পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হাসপাতালে এসে চিকিৎসা প্রদানে বাধা প্রদান করে এবং রোগী ভর্তি করতে নিষেধ করে। রোগীর ভর্তি রেজিস্টার চেক করে এবং রোগীদের তালিকা নিয়ে যায়। ১৯ জুলাই সকাল থেকে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় সন্ত্রাসীরা হাসপাতালের গেট অবরোধ করে চেয়ার নিয়ে সারা দিন বসে ছিল। তারা কোনো রোগী হাসপাতালে ঢুকতে দেয়নি। সেদিন হাসপাতালে কোনো অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে দেয়নি এবং বের হতেও দেয়নি।’
বিকল্প পথে রোগী প্রবেশের ঘটনা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের টেকনোলজিস্ট মিতুর স্বামী মোস্তাকিন বিল্লাহ মিরপুর ১০ নম্বর গোল চত্বরে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়। তাকে বিকল্প পথে আমাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার জরুরি অপারেশনের প্রয়োজনে নিউরো সার্জন আনার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর প্রয়োজন থাকলেও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা অ্যাম্বুলেন্স বের হতে দেয়নি। পরবর্তীতে তাকে বিকল্প পথে নিউরো সাইন্স হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তাকে ভর্তি না নেওয়া হলে তাকে ইবনে সিনা ধানমন্ডি শাখায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’