রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতির চালিকাশক্তি তৈরি পোশাক শিল্প বর্তমানে এক নজিরবিহীন অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। যুক্তরাষ্ট্রের ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কের কারণে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়েছে। এ পরিস্থিতি সামাল না দিলে শুধু রপ্তানি নয়, দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি, কর্মসংস্থান ও সামাজিক স্থিতিশীলতাও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
মার্কিন শুল্ক আরোপ এমন একসময় এলো, যখন বাংলাদেশ কভিড-পরবর্তী সময়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে মার্কিন বাজারে নিজের অবস্থান মজবুত করছিল।
শুধু ২০২৪ সালেই যুক্তরাষ্ট্রে আমরা ৭.৪ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছি। তবে এখন এই শুল্ক কাঠামো ৮২ শতাংশ পর্যন্ত গড়াতে পারে, যা হলে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। এরই মধ্যে এর প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। মার্কিন ক্রেতারা অর্ডার স্থগিত করছেন, কেউ কেউ বিকল্প উৎস খুঁজছেন।
কিছু রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের অর্ডার গ্রহণই কমিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে সামনের গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে যা নিট গার্মেন্টসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে যাচ্ছে। আমাদের আশঙ্কা, ২৫ শতাংশ পর্যন্ত অর্ডার আমরা হারাতে পারি।
জর্দান, মিসর, কেনিয়া ও ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলো মার্কিন ক্রেতাদের জন্য নতুন গন্তব্য হয়ে উঠছে।
এসব দেশের ওপর শুল্ক তুলনামূলকভাবে কম। যদিও অবকাঠামো দুর্বল, তবু ইতিহাস বলে, একবার কোনো দেশে ব্র্যান্ড ঢুকলে বিনিয়োগ দ্রুত সরে যায়। আমাদের নিজের অভিজ্ঞতাও তাই বলে। যেমনটা আমরা চীন ও শ্রীলঙ্কা থেকে অর্ডার স্থানান্তরের মাধ্যমে পেয়েছিলাম। এবার সেই ঘটনাটিই আমাদের বিপরীতে ঘটতে পারে।
আমাদের অনেক প্রতিষ্ঠান মার্কিন বাজার মাথায় রেখে সম্প্রসারণ করেছে। নতুন যন্ত্রপাতি, দক্ষ জনবল নিয়োগ ও ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে তারা সক্ষমতা বাড়িয়েছে। এখন সেই বিনিয়োগই ঝুঁকির মুখে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে শ্রমিক ছাঁটাই, মজুরি কমানো কিংবা কারখানা বন্ধের মতো বাস্তবতা তৈরি হতে পারে, যা কেবল অর্থনৈতিক নয়, সামাজিকভাবে ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে।
সরকার বলছে, আলোচনা চলছে। ১ আগস্ট পর্যন্ত একটা টাইমলাইনও আছে। কিন্তু এই আলোচনায় তেমন কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। মার্কিন ব্র্যান্ডগুলো রপ্তানিকারকদের শুল্কের অংশ বহনের চাপ দিচ্ছে। এতে লাভের মার্জিন কমে যাচ্ছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে লোকসান গুনছে। সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হলো, আমাদের শিল্প নেতৃত্বও এই ইস্যুতে শক্ত অবস্থান নিতে পারেনি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সময় চেয়েও পাচ্ছি না। এ ছাড়া আবার মার্কিন তুলা উৎপাদনকারী লবিগুলোও কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ সরকারের উচিত শক্তিশালী কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক, পরিসংখ্যান ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা কাজে লাগিয়ে শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জোরালোভাবে তুলতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মার্কিন সফর জরুরি হয়ে পড়েছে। তাঁর আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক এই সংকটে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
লেখক: সাবেক সহসভাপতি, বিজিএমইএ