ঝলমলে লাইট, ক্যামেরা, অ্যাওয়ার্ড শো, বিলবোর্ডে ঝুলে থাকা মুখ, লাইভ শোতে দর্শকদের উল্লাস- এ সবই শোবিজ জগতের বাহ্যিক চিত্র। এই গ্ল্যামারের আলোর নিচে যে অন্ধকারের স্তর, তা দর্শকের চোখে পড়ে না। কিন্তু অন্ধকারের ভয়ংকর রূপ হরহামেশাই ধরা দেয় নানাভাবে। সেসব নিয়েই আজকের প্রতিবেদন তৈরি করেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
শোবিজ জগৎকে বাহ্যিক দৃষ্টিতে যতটা ঝলমলে মনে হয়, আসলে কি তাই? বোদ্ধা শ্রেণির মতে- এক কথায় ‘না’। চলচ্চিত্রবোদ্ধা অনুপম হায়াৎ-এর মতে ‘এখানে যত আলো তত অন্ধকার’। কারণ এই জগতে আসার পেছনে যে উদ্দেশ্যগুলো কাজ করে সেগুলোর বেশির ভাগই মোহের ঘোরটোপে বন্দি থাকে। যেমন সহজেই অর্থবিত্ত আর খ্যাতি লাভের আশায় শোবিজ দুনিয়ায় পা রাখেন আগন্তুকরা। এতে কেউ হয়তো মেধা আর দক্ষতা দিয়ে সফল হন কেউবা আবার চোরাবালিতে পা দিয়ে অন্ধকারে ডুবে যান। শুধু তাই নয়, এই জগতে হিংসা-বিদ্বেষ-লোভ আর অসম প্রতিযোগিতার দৌড়ে অকালে নিভে যায় অনেক প্রাণ। আমাদের চলচ্চিত্র জগতে নব্বই দশকের দুটি ঘটনার কথাই যদি মনে করি তাহলে এ চিত্র চোখের সামনে নিরেট সত্যি হয়ে ওঠে। প্রথম ঘটনাটি হলো ঢাকাই চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহের। তিনি ১৯৯৩ সালে চিত্রজগতে পা রাখেন। শুরুতেই সাফল্যের বরপুত্র তার ক্যারিয়ারে সহজেই ধরা দেয়। রাতারাতি তিনি খ্যাতি আর অর্থ প্রাচুর্যের দেখা পান। কিন্তু এই সফলতা তাকে বেশি দূর বয়ে নিয়ে যেতে দেয়নি অদৃশ্য কিছু অশুভ শক্তি। মাত্র তিন বছরের ক্যারিয়ারে তাকে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হয়। যে মৃত্যু এখনো রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে। সমসাময়িক আরেকটি ঘটনা ঘটল চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীর ক্ষেত্রেও। ১৯৮৪ সালে চলচ্চিত্রে অভিনয়ে আসা এই নায়ক অল্প সময়ে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। কিন্তু এই শোবিজ অঙ্গন নিয়ন্ত্রণকারী এক গডফাদারের রোষানলে পড়ে ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে ট্রাম্পস ক্লাবের নিচে দুর্বৃত্তের গুলিতে তার বুক ঝাঁজরা হয়। অন্যদিকে শোবিজ জগতে নায়িকা হতে আসা অনেক তরুণী মোহ ভঙ্গের কারণে অল্প সময়ে বিপথে পা বাড়ান, আবার কেউবা হতাশায় আত্মহননের পথ বেছে নেন। এমন বিপথগামী এবং আত্মহননের ভূরি ভূরি ঘটনা রয়েছে আমাদের এই শোবিজ দুনিয়ায়। এখানে এমন কয়েকটি ঘটনার কথা তুলে ধরলে পাঠক হয়তো সহজেই অনুমান করতে পারবেন তাদের মোহ আর স্বপ্নভঙ্গের যাতনার কথা। যেমন ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর বুড়িগঙ্গা নদীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর পিলারের পাশ থেকে মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নির (২৪) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। পরের দিন পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের নামে একটি হত্যা মামলা করে। এরপর সাতজন তদন্ত কর্মকর্তার হাতবদল হয়ে আট বছর পর ২০১০ সালে সাবেক ছাত্রনেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভিকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। দীর্ঘ ১৪ বছর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোছা. শাহীনুর আক্তারের আদালত মামলাটির রায় ঘোষণা করেন। এতে অভিযুক্ত অভিকে খালাস দেওয়া হয়। আরেক অভিনেত্রী মিতা নূর। নব্বই দশকের দারুণ জনপ্রিয় এক মিষ্টি অভিনেত্রী। ২০১৩ সালের ১ জুলাই রাজধানীর গুলশানে নিজ বাসার ড্রইংরুম থেকে এ অভিমানীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ মৃত্যুর রহস্য আজও চাপা পড়ে আছে। তবে অনেকে মনে করেন, ক্যারিয়ার নিয়ে হঠাৎ হতাশা ভর করলে তিনি এমন কাণ্ড ঘটান। ২০১৩ সালের ২৪ মার্চ নিজ ফ্ল্যাটে ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেন লাক্স তারকা, ‘খোঁজ : দ্য সার্চ’ এর অভিনেত্রী সুমাইয়া আসগর রাহা। এ আত্মহত্যারও কোনো কারণ জানতে পারেনি কেউ। যদিও তার বাবা মেয়ের মৃত্যু নিয়ে একেকবার একেক রকম তথ্য দিয়েছেন। ২০১৪ সালে আত্মহত্যা করেন হুমায়ূন আহমেদের ‘এই সব দিন রাত্রি’ ধারাবাহিক নাটকের টুনি চরিত্র রূপদানকারী অভিনেত্রী লোপা নায়লা। তার অপমৃত্যুও রহস্যঘেরা রয়ে গেছে। ২০১৫ সালের ২০ মার্চ রাজধানীর শ্যামলীর বাসা থেকে তরুণ অভিনেত্রী নায়লার সিলিং ফ্যানে ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ মৃত্যুর পেছনেও ছিল পরিবার ও ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা। ২০১৭ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে চট্টগ্রামে নিজ গ্রামের বাড়িতে আত্মহত্যা করেন অভিনেত্রী জ্যাকুলিন মিথিলা। মূলধারায় খুব বেশি কাজ না করলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় তার বেশ পরিচিতি ছিল। ছিলেন কিছুটা বিতর্কিতও। একই বছরের ৩১ জুলাই আত্মহত্যা করেন র্যাম্প মডেল ও অভিনেত্রী রিসিলা বিনতে ওয়াজের। এ অপমৃত্যুর কারণও ছিল নাকি হতাশা। ২৪ মে ২০১৬। মঙ্গলবার ভোর ৫টা। মিরপুরের রূপনগরে বাসার ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন মডেল সাবিরা। এ মডেল আত্মহত্যার আগে ফেসবুকে দুটি স্ট্যাটাস ও ভিডিও বার্তা দেন। সাবিরা বেশ কিছু পণ্যের স্থিরচিত্রে মডেল হয়েছিলেন। মডেলিং ছাড়া উপস্থাপনায়ও তাকে দেখা গেছে। ২০২৩ সালের ২ নভেম্বর ফ্যানের সঙ্গে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন দর্শকপ্রিয় অভিনেত্রী হোমায়রা হিমু। এ মৃত্যুর পেছনে অনেকে তার কাজ কমে যাওয়া, একাকিত্ব, ব্যর্থ প্রেম, ব্যর্থ বিয়ে ইত্যাদিকে দায়ী করেন। এদিকে শুধু দেশে নয়, বিদেশের শোবিজ জগতের এ চিত্রও অভিন্ন। ২০২২ সালের মে মাসে ঘটে যাওয়া ভারতীয় টিভি অভিনেত্রী পল্লবী দের মৃত্যুরহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। একই মাসে উদ্ধার করা হয় কলকাতার মডেল-অভিনেত্রী বিদিশা দে মজুমদারের ঝুলন্ত লাশ। এর পরের সপ্তাহেই মডেল-অভিনেত্রী মঞ্জুষা নিয়োগীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে কলকাতা পুলিশ। পর পর এ তিনটি ঘটনা নিয়ে হইচই পড়ে যায় দুই বাংলায়। কিন্তু কী কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন উঠতি মডেল-অভিনেত্রীরা এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে শোবিজ অঙ্গনের ঝলমলে আলোর ওপাশের অন্ধকারের কথা জানান টলিউডের গুণী নির্মাতা সৃজিত মুখার্জি। তার ভাষায়, ‘ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন কেউ কাজ করতে চাইলে তাকে সোজা বারণ করি। এমন নৈরাশ্যের জায়গা, যেখানে সাফল্যের দৈনিক হার এক বা দুই শতাংশ, সেখানে কারও আসা ঠিক নয়। ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেও হতাশা-ই বেশি মিলবে। এমন ইন্ডাস্ট্রিতে কেউ কাজ করতে আসে?’। ইন্ডাস্ট্রির বাস্তবতা নিয়ে কেউ কথা বলেন না, তা উল্লেখ করে সৃজিত মুখার্জি বলেন, ‘আমরা শুধু ঝলমলে তারকাদের দিকে তাকিয়েই ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের স্বপ্ন দেখি। বাস্তব যে কী, তা নিয়ে কেউ বিশেষ মুখ খোলেন না। নতুন প্রজন্মকে তো এই ইন্ডাস্ট্রির বাস্তব দিকটা জানতে হবে।’ নতুন ছেলেমেয়েরা সিনেমা বা ধারাবাহিকে কাজ করতে চেয়ে সৃজিতের পরামর্শ চান। তা স্মরণ করে সৃজিত বলেন, ‘আমি প্রথমেই বলি, এখানে কাজ করতে এসো না। সিনেমায় কাজ করা আর হাঙরের সঙ্গে সাঁতার কাটা দুটোই এক। অনেকে সংবাদমাধ্যমে সাফল্যের আলো দেখে এ কাজে আসতে চান। তারা জানেন না এ আলো শুধু কয়েকজনের ওপরেই পড়ে।’ আসলে শোবিজ জগতে ‘আলো-আঁধারের হাতছানি’ বলতে বিনোদন শিল্পের উত্থান-পতন, সাফল্য-ব্যর্থতা, খ্যাতি ও বিতর্কিত ঘটনাগুলোর মিশ্রণকে বোঝায়। এখানে আলো বলতে জনপ্রিয়তা, খ্যাতি, অর্থ এবং সাফল্যকে বোঝায়, যা এ জগতের একটি উজ্জ্বল দিক। অন্যদিকে আঁধার বলতে বিতর্ক, সমালোচনা, ব্যক্তিগত সমস্যা, ব্যর্থতা এবং পেশাগত জীবনে উত্থান-পতনের মতো বিষয়গুলোকে বোঝায়। এ ‘আলো-আঁধারের হাতছানি’ শোবিজ জগতের একটি স্বাভাবিক চিত্র। যেখানে একজন তারকা খুব সহজেই খ্যাতি এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠতে পারেন, আবার কিছু বিতর্কিত ঘটনার কারণে তার ক্যারিয়ার ধ্বংসও হতে পারে। সুতরাং শোবিজ জগতের এ আলো-আঁধারের খেলা সব সময় বিদ্যমান। এখানে একদিকে যেমন সাফল্যের হাতছানি রয়েছে, তেমনি রয়েছে ব্যর্থতা ও বিতর্কিত ঘটনার ঝুঁকি।