এএফসি উইমেন্স এশিয়ান কাপ কোয়ালিফায়ারে ‘সি’ গ্রুপে বাংলাদেশের তিন অচেনা প্রতিপক্ষের মধ্যে দুটিই ছিল ফিফার র্যাংকিংয়ে অনেক এগিয়ে। তা সত্ত্বেও আত্মবিশ্বাস, সাহস এবং মনঃসংযোগের সঙ্গে দলবদ্ধ লড়াইয়ের মঞ্চে কোচের ম্যাচ পরিকল্পনা পেশাদার মানসিকতায় বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে বলেই অপরাজিত গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে এবারই প্রথম দক্ষিণ এশিয়ার গণ্ডি অতিক্রম করে এশিয়ার বড় গণ্ডিতে স্থান হয়েছে। নারী ফুটবলে এটি অনেক বড় ঘটনা। ফুটবল ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
এই উত্থানের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে ফুটবলে নারীদের সম্ভাবনা অনেক বেশি। নারী ফুটবল এখন বাংলাদেশের ইতিবাচক বিজ্ঞাপন। অগ্রগতির বড় উদাহরণ। সমাজে অবহেলা, বঞ্চনা এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
আন্তর্জাতিক নারী ফুটবল উৎসব বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় নারী ফুটবলের সাফল্য নিয়ে পুরো দেশ মেতে উঠেছিল। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই দেশের সম্মানের জন্য আরেকটি লড়াইয়ে নামছে আজ বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২০ নারী দল। এটি হলো ‘সাফ অনূর্ধ্ব-২০’ উইমেন্স চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৫। বাংলাদেশ জাতীয় দল না হলেও অনূর্ধ্ব-২০ স্কোয়াডে আছেন অধিনায়কসহ ৯ জন ফুটবলার, যাঁরা সদ্যঃসমাপ্ত উইমেন্স এশিয়ান কাপে অংশ নেওয়া জাতীয় স্কোয়াডে ছিলেন।
সংগতভাবেই তাই অনূর্ধ্ব-২০ দল ভারসাম্যময় এবং শক্তিশালী। ‘ফেভারিট’ হিসেবেই খেলতে নামবে। জাতীয় দলের অধিনায়ক আফইদা খন্দকার অনূর্ধ্ব-২০ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ দলের নেতৃত্ব দেবেন। নারী ফুটবলারদের জন্য এটি আরেকটি নতুন চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ অবশ্য গত পাঁচ আসরের মধ্যে চারবার শিরোপা জিতেছে।
সাফল্য অনেক সময় বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। প্রত্যাশা বেড়ে যায়। আজ থেকে শুরু হওয়া (১১ থেকে ২১ জুলাই) চ্যাম্পিয়নশিপ ঘিরে প্রত্যাশা একটিই, শিরোপা। ফুটবল কি সব সময় প্রত্যাশা অনুযায়ী সাড়া দেয়? তা তো নয়। মাঠে দল হয়ে প্রথম থেকে আত্মবিশ্বাস এবং সাহসের সঙ্গে গেম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, পাশাপাশি প্রয়োজন ভাগ্যের সহায়তা। কোচ পিটার বাটলার বাস্তববাদী। তাঁর কথা হলো প্রতিপক্ষকে ‘রেসপেক্ট’ করে খেলেই জিততে হবে। সুযোগ আছে নতুনদের পরখ করে নেওয়ার।
ভারত অংশ না নেওয়ায় টুর্নামেন্টের ‘ফরম্যাটে’ বদল এসেছে। এখন খেলা হবে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে ডবল লীগ পদ্ধতিতে। একটি দল ছয়টি করে ম্যাচ খেলবে। সর্বোচ্চ পয়েন্ট পাওয়া দল চ্যাম্পিয়ন হবে।
আন্তর্জাতিক নারী ফুটবল উৎসব বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় অনূর্ধ্ব-২০ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবল উৎসব অনুষ্ঠিত হবে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ‘এল ব্লকে’ ৩০০ বিঘা জমির ওপর মাল্টি স্পোর্টস কমপ্লেক্সের মধ্যে বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায়। আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধায় সমৃদ্ধ ফিফা ও এএফসি স্বীকৃত বৃহৎ করপোরেট গ্রুপের নয়নাভিরাম প্রাইভেট সেভিয়াস। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে কোনো ক্লাবের হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে ম্যাচ, আন্তর্জাতিক ম্যাচ ও টুর্নামেন্ট আয়োজনের জন্য এ ধরনের আধুনিক প্রাইভেট অ্যারেনা আর একটিও নেই। বসুন্ধরা গ্রুপ পরিচালিত ক্লাব হলো বসুন্ধরা কিংস। এটি কিংসের হোম ভেন্যু। গ্রুপ বছরের পর বছর ধরে দেশে সুন্দর ফুটবল পরিবেশ সৃষ্টি এবং খেলার মানোন্নয়নে প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা পালন করে চলেছে। অ্যারেনাটি শুধু গ্রুপের নয়, দেশের ফুটবলের ভাবমূর্তি। মাল্টি স্পোর্টস কমপ্লেক্সের স্লোগান হলো ‘আগামী এখানেই’। কমপ্লেক্সের সব কাজ সম্পন্ন হলে এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ায় অনুকরণীয়।
ক্রীড়ানুরাগী ব্যক্তিত্ব, একসময়ের কৃতী হকি খেলোয়াড় এবং বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহানের স্বপ্ন—‘স্পোর্টস কমপ্লেক্স’। আর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাঁর উদ্দেশ্য হলো দেশের ক্রীড়াঙ্গনে বিভিন্ন খেলার চর্চা, মানোন্নয়ন এবং অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখা। স্বপ্ন এখন একটির পর একটি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
অনূর্ধ্ব-২০ সাফ উইমেন্স ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ, ‘আন্তর্জাতিক ফুটবল ইভেন্ট’ প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায়। ১১ জুলাই দিনটি মাইলস্টোন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এর আগে কিংস অ্যারেনায় এএফসি ও ফিফার আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হলেও আন্তর্জাতিক ফুটবলের কোনো টুর্নামেন্ট বা চ্যাম্পিয়নশিপ অনুষ্ঠিত হয়নি।
২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে রঙিন বেলুন উড়িয়ে বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনার উদ্বোধন করেন গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বসুন্ধরা কিংসের সভাপতি মো. ইমরুল হাসান, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তা, আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়াও গ্যালারিতে উপস্থিত ছিলেন ফুটবলপ্রেমিক দর্শক। দিনটি ফুটবল ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে এ জন্য যে দেশে প্রথম ফিফা ও এএফসি স্বীকৃত প্রাইভেট অ্যারেনার যাত্রা শুরু। উদ্বোধনী দিনে বসুন্ধরা কিংস তাদের হোম ম্যাচ খেলেছে পুলিশ এফসির বিপক্ষে এবং পরাজিত করেছে ৩-০ গোলে।
খেলার মধ্যবিরতির সময় গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান সাংবাদিকদের সঙ্গে বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। জানিয়েছেন স্পোর্টস কমপ্লেক্সের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে। কথা বলেছেন দেশের ফুটবল ও তার মানোন্নয়ন নিয়ে।
খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ এবং দুর্বলতা গ্রুপের এই শীর্ষ কর্মকর্তার আজন্ম। সব সময় সমতার ক্রীড়াঙ্গন নীতিতে বিশ্বাসী। মনে আছে, কিংসের সভাপতি মো. ইমরুল হাসান কথা প্রসঙ্গে একদিন বলেছেন, ‘চেয়ারম্যান স্যার আমাকে কমপ্লেক্সের মধ্যে মেয়েদের জন্য পৃথক প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড নিশ্চিত করার জন্য বলেছেন। মেয়েদের ফুটবল ঘিরে তিনি দারুণ উৎসাহী এবং আশাবাদী। ঢাকা শহরে তো মেয়েদের খেলার জন্য কোনো পৃথক মাঠ নেই।’
২০২২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন, তখন এক প্রশ্নের উত্তরে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘আমরা এখন যে পর্যায়ে আছি, সেখান থেকে মেয়েদের একটা বিশাল ভবিষ্যৎ আছে, ওদের ওখান থেকে বিশ্বমানে নিয়ে যাওয়া যাবে। বসুন্ধরা গ্রুপ মেয়েদের ফুটবলকে প্রটেকশন দিচ্ছে, পৃষ্ঠপোষকতা করছে।’ (হুইসেল এএফসি কাপ বিশেষ সংখ্যা, পৃষ্ঠা-৬৬, মে ২০২২)
বাংলাদেশের অদম্য নারী ফুটবলাররা গত ২ জুলাই ২০২৫ মায়ানমারে এএফসি উইমেন্স এশিয়ান কাপের কোয়ালিফাইংয়ের খেলায় স্বাগতিক মায়ানমারকে ২-১ গোলে পরাজিত করে চূড়ান্ত আসরে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছেন। স্থান করে নিয়েছেন স্বপ্নের ফুটবল ঘরে। এখন এগিয়ে যাওয়ার পালা। অবাক হচ্ছি নারী ফুটবল ঘিরে বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান সাহেবের দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, আস্থা ও বিশ্বাসের কথা ভেবে।
লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত